জামালপুরের বকশিগঞ্জ থেকে বৃহস্পতিবার তোলা ছবি
বন্যা কী আছে, বন্যা কী নেই?
আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৭, ২০:০০
বন্যার কী অবস্থা জানতে শুক্রবার ছুটির দুপুরে একটি খ্যাত দৈনিকের অনলাইন ভার্সন খুললাম। ঘড়ির কাটা তিনটা বিশের ঘরে, কিন্তু ল্যাপটপের পর্দাজুড়ে দৈনিকটির প্রথম পাতায় বিশটা তো ‘দূরকা বাত’, তিনটাও বন্যার খবর নেই। নিজ জেলার নিম্নাঞ্চলেও বানের পানি ঢুকেছে, সঙ্গত কারণ ও আশঙ্কাতেই মনোযোগী চোখ বুলানো। কিন্তু একী! পাতাটির প্রধান ছয়টি খবরের মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের বিগত নায়িকা শ্রীদেবির খবর থাকলেও প্রতিবেশীর ‘দান’জনিত দেশের বান কিংবা বানভাসিদের কোনো খবরের জায়গা সেখানে হয়নি!
নিচের দিকে নামলাম স্পেন হামলায় দুঃখ প্রকাশ নিয়েও খবর আছে, পর্দার পুরোটাই খুঁজলাম, কিন্তু ত্রাণ দিতে যাওয়া রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া বন্যার অন্য কোনো খবর নেই, আপডেট নেই। আরও নিচে সাবেক এমপির স্বাস্থ্যজনিত বিবরণ রয়েছে, টিভি উপস্থাপিকার ধর্ষণের খবর রয়েছে, আন্তর্জাতিকে রয়েছে বার্সেলোনায় ৫ সন্ত্রাসী নিহত হবার খবরও, কিন্তু শতাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রলংকরী বানের কেনো খবর নেই, ধ্বংসের কোনো আপডেট নেই, কবলিত মানুষের কী অবস্থা তার কোনো বিবরণ নেই! সঙ্গত কারণেই বিস্মিত দুচোখ কপালে ওঠার কথা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠার কথা, তবে কী দেশে কোনো বন্যা নেই? না থাকলে নাই, কী আর করার।
তবে বন্যা থাকুক আর না থাকুক, অনেকেই কিন্তু বন্যার উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন, বানের পানির সাথে পলি আসে, মাটি উর্বর হয়, কত কী। অনেকটা ছোটবেলার রচনা লেখার মতোন, উপকারিতা আর অপকারিতা থাকে পাশাপাশি। অপকারিতার সাথে উপকারিতার কথাও বলতে হবে, উপকারিতার পর অপকারিতা। তবে এ বয়সে শতাধিক মানুষের মৃত্যু, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, বিনষ্ট ক্ষেতের ফসল ছাপিয়ে যখন বন্যার উপকারিতার বিষয়াদি সমুখে আসে, তখন বড় বিষম লাগে। যখন ‘পলিজনিত কারণে মাটির উর্বরতা’ বিষয়ক রচনা শেখানো হয় তখন কেন জানি ‘কাপালিক’দের কথা মনে পড়ে যায়। ‘হরর’ মুভিতে দেখা সেই ভয়াবহ ‘কাপালিক’, যারা মানুষের মঙ্গলের কথা বলে মানুষকেই বলির কাঠে চড়ায়। বন্যায় অন্যায় ভেসে যাবার মতোন শ্লোগানও শুনি, তেমন কথাও বলেন অনেকে। ঠিক যেন সেই ‘কাপালিকে’র ভাষা। বন্যার প্রথম দুদিনেই মারা গেছেন আটান্ন জন মানুষ, সর্বশেষ সংখ্যা বোধ করি দুশো’র কাছাকাছি। এমন বন্যায় অন্যায় ভাসানোর শ্লোগান কতটা অমানবিক, কতটা মর্মন্তুদ, তারা যদি তা একবারও বুঝতেন।
অবশ্য বোঝার কথাও নয়, না বোঝাটাও দোষের নয়। 'কভু আশী বিষে দংশেনি যারে', যারা প্রাসাদ কিংবা হাইরাইজের ফ্ল্যাটে থাকেন, সেই শ্রেণির ‘বিষ’ তথা বানের পানির যাতনা বোঝার কথা নয়। নিন্দুকেরা অবশ্য এক্ষেত্রে মুখ বাঁকিয়ে বলতে পারেন, 'দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন'। 'অন্নে'র কথায় মনে পড়ল- এ দেশের মানুষের বর্তমান বন্যায় ভাতে মরার অবস্থা নেই। আয়-ইনকাম বেড়েছে, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এখন, সুতরাং না খেয়ে মরার সম্ভাবনা ‘দূরস্ত’। ‘দুর্ভিক্ষ’ তথা ভিক্ষার অভাব হবারও সম্ভাবনা নেই। উঁচু শ্রেণি ও স্থানে বাসরত মানুষেরা এমনটাই ভাবেন এবং বলেন। ভিক্ষার যে অভাব হবে না অভ্যস্ততা তাদের এতটাই নিশ্চিত করেছে। সাগরে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়, আর কী।
তবে এমন যারা বলেন তারা যদি দিনাজপুর বা কবলিত এলাকায় থাকতেন, তখন বুঝতেন, পকেটে লাখ টাকার বান্ডেল থাকলেও সময়ের ফেরে এক প্যাকেট বিস্কুটও কেনা যায় না। সোনার খাট কেনার সামর্থ্য থাকলেও, শোবার উপায় থাকে না। ‘লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা’, চারিদিকে পানি থাকলেও পানীয়ের অভাবে 'ডিহাইড্রেশন' হয়। ‘পানীয়’ বলেও বোধহয় বিপদে পড়লাম, ‘পানীয়’ বলতে আবার কেউ কেউ বিশেষ ‘পানীয়’ বোঝেন, ‘তৃষ্ণা’ বলতেও কেউ বেঝেন ভিন্ন ‘তৃষ্ণা’। এক্ষেত্রে অবশ্য ‘কমন’ মিলের একটা ব্যাপার রয়েছে। যেমন- কারও প্রার্থিত বিশেষ ‘পানীয়'ও অনুপ্রবেশ করে প্রতিবেশী দেশ থেকে, বানের পানিও তাই। দুটোই হয়তো কারও কাছে অমৃত, আক্রান্তদের কাছে বিষ। যে সে বিষ নয়, সক্রেতিসের হেমলক। 'তুমি বেঁচে থাকবে, আমি মারা যাব, কোনটা শ্রেয়তর তা ঈশ্বরই জানেন।' মানুষ যখন অসহায় হয়ে উঠে তখন ঈশ্বরের স্মরণ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না, সক্রেতিসে’রও ছিল না।
আমাদের দিক থেকে আমরা কলামের পর কলাম লিখতে পারি, সাময়িক পরিত্রাণের জন্য ত্রাণ শিবির খুলতে পারি, সহায়তার জন্য হাত বাড়াতে পারি। কিন্তু তারপর, কতদিন টানব তাদের আমরা, যারা স্বজন হারিয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন, বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়েছেন। দীর্ঘ মেয়াদে তাদের প্রয়োজন পরিত্রাণ বিষয়ক পরিকল্পনা। কিন্তু শেষমেষ ‘পরিত্রাণ ও পরিকল্পনা’র ‘পরী’ যখন স্বার্থান্ধ আকাশে উড়ে যায় তখন শুধু ত্রাণের কল্পনাই পড়ে থাকে। তখন ঈশ্বর ছাড়া তাদের আর কোনো সহায় থাকে না, প্রার্থনার জায়গা থাকে না। দীর্ঘদিনের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা অন্তত সেকথাই বলে।
সুতরাং ঈশ্বরের সাহায্য বিষয়ে তসলিমা নাসরিনরা যতই রঙ্গ-ব্যাঙ্গ করুন, অসহায়দের ঈশ্বর ছাড়া আর কোনো ভরসা এবং প্রার্থনার জায়গা নেই। যাদের এখনও সহায় আছে, সহায়হীন হননি তারা রঙ্গ-ব্যাঙ্গ করতে পারেন। সহায় যত দিন আছে ততো দিন করুন। কিন্তু তারপর? গণিতের এক অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘আমরা ভাবি আমাদের অঙ্ক সব মিলে গেছে, আসলে মেলে না কিছুই। অঙ্কের কোনো শেষ নেই, সব ইনফিনিটি।’ সত্যি কথা, তারপর সব ‘ইনফিনিটি’।
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]
- ট্যাগ:
- অন্যান্য সংবাদ
- বাংলাদেশ
- বন্যা- ২০১৭