কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা। ছবি: প্রিয়.কম

রোহিঙ্গা ইস্যু: কিছু প্রশ্ন

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৮
আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৮

এক

বিগত ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর বিবিসি’র একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, “রোহিঙ্গা মুসলিমদের বার্মায় ‘পুশব্যাক’ করছে বিজিবি”। শুরুতেই সংবাদটির বর্ণনা ছিল এ রকম, “মিয়ানমারে মুসলিম-অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে গত ৫ দিনে সেনা অভিযানে অন্তত ৬৯ জন নিহত হবার পর আতংকিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করলে সীমান্তরক্ষী বিজিবি তাদের 'পুশব্যাক' করেছে, বলছে এএফপি।” অর্থাৎ বাংলাদেশের তখনকার নীতি ছিলো পুশব্যাকের। প্রায় ১ বছর পর অর্থাৎ চলতি সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে এনটিভি অনলাইনে’র আরেকটি খবরের শিরোনাম হলো, ‘আরও ৫৫৩ রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক’। মাঝখানের প্রায় এক বছরের ব্যবধান, কিন্তু রিপোর্ট দুটির মধ্যে কী কোনো মৌলিক ব্যবধান দৃশ্যমান? উত্তর, না! অন্তত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত পুশব্যাক দৃশ্যপটের দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি।

গেল মাস, অর্থাৎ ২৮ আগস্টের আরেকটি গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হলো, ‘টেকনাফের কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট থেকে অনুপ্রবেশের সময় ২২৪ রোহিঙ্গা আটক পুর্বক পুশব্যাক করেছে বিজিবি। এসময় অনুপ্রবেশে সহযোগিতাকারী ২ দালালকে আটক করা হয়।’ সংবাদে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পুশব্যাকের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা হয়েছে। আর এমন প্রবেশে যারা সাহায্য করেছেন তাদের বলা হয়েছে ‘দালাল’। অনেকে বলবেন ঠিকই তো, তারা তো দালালই, টাকার বিনিময়ে যারা অনুপ্রবেশে সাহায্য করে তাদের আর কী বলবেন। একেবারে ঠিক, কিন্তু এই ঠিকের অভ্যন্তরে যা বেঠিক তা হলো, খুলে দেওয়া সীমান্তে দালালের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটি। অনেকটা সোজা হিসাবে বলা যায়, এই সংবাদটির প্রকাশকাল অনুযায়ী রোহিঙ্গারা ছিল অনুপ্রবেশকারী, অপর দেশে অনুপ্রবেশ একটি অপরাধ, অর্থাৎ তারা অপরাধী। যদি সীমান্তই মানবিক কারণে খুলে দেওয়া হয় তবে দালালের কী প্রয়োজন, রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশকারী হয় কীভাবে, পুশব্যাক কেন? এমন কটি প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে হয়তো অনেক ‘কেন’র উত্তর। যারা সত্যিকার অর্থেই উত্তর খুঁজতে চান, বুঝতে চান তারা চিন্তা ও চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

দুই

২৮ আগস্টের আরেকটি সংবাদ নিয়ে কথা বলি। দেশের যশস্বী দৈনিক ‘ইত্তেফাকে’র শিরোনামটি ছিল, ‘মিয়ানমার সীমান্তে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব বাংলাদেশের’। সংবাদটির শুরুতে ছিল, ‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গত বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের পর সন্ত্রাসীদের বাঙালি হিসেবে অভিহিত করায় সোমবার দেশটির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিনকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রদূতকে মিয়ানমারের ইসলামি জঙ্গি, আরাকান আর্মি ও অন্য যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ লক্ষ্য করুন সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে’ কথাটি। এখন তো আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছি, এদের মধ্যে কে ইসলামি জঙ্গি, আরাকান আর্মি বা ‘যেকোনো শক্তি’ তা চিহ্নিত করার তো কোনো উপায় নেই। সেই হিসাবে মগের মুল্লুকের মগে’রা যদি আমাদেরই এখন ‘অন্য যেকোনো শক্তি’ হিসাবে আখ্যায়িত করে তবে?  

‘সন্ত্রাসীদের বাঙালি হিসেবে অভিহিত করায়’ সংবাদের এ অংশটি বাদ পড়ে গেল, এমন দৃশ্যমান শব্দমন্ডলির প্রতিও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ‘বাংলাভাষি’ অর্থাৎ যারা বাংলায় কথা বলেন এমন সম্প্রদায়ের পরিচিতি হয় ‘বাঙালি’। পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশেও প্রচুর ‘বাঙালি’ রয়েছেন, এনারাও বাংলায় কথা বলেন। আরাকান আর প্রতিবেশী দেশটির মাঝে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম। সুতরাং বাংলায় কথা বললে বাঙালি বলা যেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশি বললে যে প্রশ্নের উদ্রেক হয় তা উদ্বেগজনক, কারণ তা নির্দিষ্টভাবে আমাদের ভূখণ্ডকে নির্দেশ করে। তবে বাঙালি আখ্যাতেও প্রশ্ন রয়ে যায়, ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।

তিন

মিয়ানমারের সেনারা ১৭ বার বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করেছে, এমনটাই বলেছে গণমাধ্যমগুলো। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের, এমন কী আমাদের বিজিবি পোস্ট লক্ষ্য করেও গুলি চালিয়েছে তারা, গণমাধ্যমের খবরে তাই বলা হয়েছে। সীমান্তে ল্যান্ডমাইন পোতা হয়েছে, আর এ কাণ্ড আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করেই করেছে এবং করছে মিয়ানমারের সেনারা। কিন্তু এর বিপরীতে আমাদের কর্মকাণ্ড কী?

অবশ্য এ ব্যাপারে জবাব রয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন প্রকাশিত সংবাদে একজন সরকারি দায়িত্বশীলের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে।’ তবে প্রশ্ন উঠেছে এমন বক্তব্যের সপ্তাহ পরেও কূটনৈতিক তৎপরতার দৃশ্যমান সফলতা নিয়ে। এরমধ্যে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের মিছিল আরও লম্বা হয়েছে, মগ‘দের ‘রুট আউট’ প্রক্রিয়া ‘নৃশংসতার উৎসবে’ পরিণত হয়েছে। এমন যা-তা অবস্থার মধ্যেই প্রতিবেশী একটি দেশ আওয়াজ তুলছে সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিতারণের। সম্ভাব্য বিতারিত ওই রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল কোথায় হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরটি সোজা হলেও, প্রশ্নটি কিন্তু অত সোজা নয়।  

চার

ত্রাণ আর সাহায্যের ব্যাপারে আমাদের নিজেদের অতীত খুব একটা পরিচ্ছন্ন নয়। ১৯৮৮ এর বন্যায় আসা ত্রাণ সাহায্য নিয়ে নানা প্রশ্ন এখনও গুঞ্জরিত হয়, উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে। জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের সাহায্য-পুনর্বাসনের ক্ষেত্রটি প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। তারই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে আমরা সক্ষম কী না, এমন প্রশ্নটির সাথে ‘অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান’ তিনটি বিষয়ই জড়িত। সুতরাং এসব বিষয়েও খোলাসা থাকা প্রয়োজন।

১৩ সেপ্টেম্বর যখন এ লেখা লিখছি তখন দৈনিক মানবজমিন জানালো, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৪টি হারকিউলিস বিমানে ত্রাণ আসছে। অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাদের সাহায্যের লক্ষ্য নিয়ে ত্রাণ পাঠাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এছাড়াও জাতিসংঘের দুটি ফ্লাইটও পৌঁছেছে তাবু, খাদ্য ও স্যানিটেশন সামগ্রী নিয়ে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক বলেছেন, কক্সবাজার এলাকায় প্রায় ৭০ হাজার ও আশপাশের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসরত প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে খাদ্য বিতরণ করছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। অর্থাৎ ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের খাদ্য জোগাচ্ছেন তারা। তুরস্কের সাহায্য তো আগেই পৌঁছেছে, মালয়েশিয়াও বাদ যায়নি। সুতরাং এতসব সাহায্য কীভাবে সমন্বিত হচ্ছে, কারা সমন্বয় করছেন এটাও বিশাল প্রশ্ন? এর উত্তরটাও জরুরি, না হলে ‘নেপোয় মারবে দই’, ইতোমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমে ‘নেপোর দই মারা’র কাহিনী প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।

পাঁচ

কোথায় যেন পড়েছিলাম, এক সম্প্রদায়ের মানুষ আছে যাদের কাজ হলো কেউ মারা গেছেন এমন বাড়িতে গিয়ে কেঁদে আসা। অর্থাৎ মৃতের বাড়িতে কাঁদার জন্য তাদের ভাড়া করা হয়। সিনেমাতেও রয়েছে, মরণ দৃশ্যে ‘কান্দন পার্টি’। এমন ‘কান্দন পার্টি’র দেখা মিলছে রোহিঙ্গা ক্রাইসিসে। দুদিন আগেও রোহিঙ্গারা যাদের কাছে ছিল ‘মুসলিম জঙ্গি, উগ্রপন্থী, মাদক ব্যবসায়ী’ অথচ হঠাৎ করেই তাদের উল্টো সুর, রোহিঙ্গারা তাদের কাছে হয়ে উঠেছে ‘নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষ’। রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের হেচকিময় কান্না, সিনেমার ‘কান্দন পার্টি’র প্রশ্নটিই সামনে নিয়ে এসেছে। এই কান্নাকে সমুখে রেখে অনেকের মনের ভেতর নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। অনেকে তা সামলে রাখলেও কোনো ঠোঁটকাটা ফস করে মন্তব্য করে ফেলছেন, ‘আর কিছু না হোক কান্নাতে যেন কেউ পিছে ফেলতে না পারে, সেই জন্যেই এই হেচকিময় কান্না’। মন্তব্যটা অবশ্য একটু ত্যাড়া কিসিমের, সোজাভাবেও তো বলা যেতে পারে, হাসি-কান্নাটা হলো সংক্রামক, অপরকে কাঁদতে দেখলে এমনিতেই চোখ ভিজে আসে।

সর্বশেষ

সকল ধর্মই বলে, দান হতে হয় নিঃস্বার্থ। অনেকে বলবেন, এখানে ধর্ম নয় কূটনীতিই প্রধান, কথাটা মিছা নয়। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সেবা আর দান এ দুটি ক্ষেত্রে কূটনীতি আর রাজনীতি বরং ‘অপনাম’ই বয়ে এনেছে ‘নাম’ নয়। দান-ধ্যানের ক্ষেত্রে ‘কান্দন পার্টি’র ‘কারবার’ মূলত কোনো কাজে আসে না, আসার কথাও নয়। ফাঁকিটা সবাই বুঝতে পারে, যারা পারে না তারা হয় ‘অবুঝ’ না হয় ‘অমনোযোগী’।