কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ইন্দিরা ক্যান্টিনে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত সব ধরণের মানুষ। সংগৃহীত ছবি

সকালের খাবার সাড়ে ছয় টাকা, দুপুরের ১৩

জাহিদুল ইসলাম জন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৭
আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৭



(প্রিয়.কম) বেঙ্গালুরুর ব্যস্ত মার্কেট এলাকার একটি বাড়ির সামনে সকাল সাতটা থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ খুলে দেওয়া হলো ওই বাড়ির গেট। আর সকলেই ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলির পর শুরু হলো লাইনে দাঁড়ানো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলতে শুরু করলো লাইন। নারী-পুরুষের আলাদা লাইন এগিয়ে গিয়ে ছোট একটি জানালা দিয়ে টাকা দিয়ে এক বা দুটি প্লাস্টিকের টোকেন নেওয়া শুরু হলো। এই টোকেন দিয়েই মিলবে সকালের নাস্তা।

লাইনের মানুষ আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে উজ্জ্বল হলুদ রংয়ের ট্রেতে করে খাবার সংগ্রহ নিয়ে নিতে থাকলো। আর ঘরের ভেতরে বা বাইরে পছন্দ মতো জায়গায় নিয়ে শুরু হলো খাওয়ার পর্ব।

এভাবেই ইন্দিরা ক্যান্টিনের বর্ণনা দিলেন বিবিসির সংবাদদাতা গীতা পান্ডে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে চালু হয়েছে এটি। প্রতিদিন দুই লাখ মানুষকে সস্তায় খাবার দেওয়া হয় এখান থেকে।

গীতা পান্ডে ওই ক্যান্টিনে খেয়ে ফিরে এসে সন্তুষ্ট হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু পেয়েছেন। তিনি জানান, অন্যদের মতো গীতাও টোকেন কিনে ভিড়ের মধ্যে নাস্তা নিয়ে নেন। মেন্যুতে দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় ইদলি পিঠা আর চাল দিয়ে রান্না পোঙ্গালের সাথে মিললো নারকেলের চাটনি।

গরম, তাজা, সুগন্ধ বেরোনো এই খাবার মজাদারও। আর সবচেয়ে ভালো দিক হলো প্রতি প্লেট খাবরের মুল্য মাত্র ৫ রুপি বাংলাদেশি টাকায় যার দাম সাড়ে ছয় টাকার কাছাকাছি। খাবারের তুলনায় যা প্রায় ফ্রিতেই খাওয়া বলা যেতে পারে।

গত ১৬ আগস্ট ইন্দিরা ক্যান্টিন চালু হওয়ার পর থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। প্রতিবেশি রাজ্য তামিলনাড়ুতে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা আম্মা ক্যান্টিন নামে এই ধরনের দোকান চালু করেন। বেঙ্গালুরুর এই দোকান সেই আইডিয়া ধার করেই শুরু হয়েছে। আম্মা ক্যান্টিনের ভালো খাবারও খেয়েছেন গীতা পান্ডে। তবে তার কাছে ইন্দিরা ক্যান্টিনের খাবারটা আরও ভালো।

শ্রমিক, ড্রাইভার, নিরাপত্তারক্ষী, ভিক্ষুক এবং এরকম গরিব মানুষেরাই মূলত এই ক্যান্টিনের ক্রেতা। দিনে ১০০ রুপি বা তারও চেয়ে কম রোজগারের মানুষের কাছে এই খাবার অনেকটা আশির্বাদ হয়ে এসেছে। তবে সব মানুষই খেতে পারেন এই ক্যান্টিনে।

বেঙ্গালুরুর একটি শপিং সেন্টারে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন এরশাদ আহমেদ। তিনি ইন্দিরা ক্যান্টিনে তিনি নিয়মিত খান, ‘খাবার খুবই ভালো। আগে কাছের হোটেলে সকালের নাস্তা করতেই খরচ হতো অন্তত ৩০ রুপি। এখন আমার ২৫ রুপি বেঁচে যায়।’ অন্য রাজ্যগুলোতেও এই সুবিধা চালু করার প্রস্তাব দেন তিনি।

কাছের মার্কেট থেকে ফল কিনে স্কুলের সামনে বিক্রি করেন লক্ষ্মি। তিনি বলেন, ‘এই ক্যান্টিন আমাকে সকালের খাবর তৈরির ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে। সকালে নাস্তা না বানানো আমার কাজ সহজ করে দিয়েছে। আর এই খাবার এতোই সস্তা যে যে আমার কোনো চাপই পড়ে না। আর খাবারও তো ভালো।’

কাছের একটি মেসে বাস করেন মোহন সিংহ। তিনি দিনের তিন বেলাই এক ক্যান্টিনে খান। তিন বেলা খেতে তার খরচ হয় ৪০ রুপি (৫১ টাকা ২৭ পয়সা)। তিনি বলেন, ‘বাইরে খাওয়ায় খরচ বেশি। আগে আমার দিনে প্রায় ১৪০ রুপি (১৮০ টাকার কাছাকাছি) খরচ হতো। ক্যান্টিন আমার জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ক্যান্টিন রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ ফেলবে। কিন্তু যে দেশের অনেক মানুষই দিনে এক ডলারের চেয়ে কম আয় করে, সেখানে এই ক্যান্টিন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সুবিধা দেবে।

ক্যান্টিন চালু গরিব মানুষের ক্ষুধা দূর করছে। সংগৃহীত ছবি
ক্যান্টিন চালু গরিব মানুষের ক্ষুধা দূর করছে। সংগৃহীত ছবি

অনেক বিশ্লষক মনে করেন, সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ললিতার বিজয়ী হওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো আম্মা ক্যান্টিন। কর্নাটকে আগামী বছরই নির্বাচন হবে। আর এর আগে এই ক্যান্টিন স্থাপন অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে কতৃপক্ষ বলছে, এই সিদ্ধান্ত মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

এই প্রজেক্টের দায়িত্ব থাকা কর্মকর্তা মনোজ রাজন বলেন, ‘মূখ্যমন্ত্রী গরিব মানুষকে খওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এর লক্ষ্য হচ্ছে ভাসমান লোকজন। ট্যাক্সি ড্রাইভার, ছাত্র, বাইরে কাজ করা দম্পত্তি। যাদের হাতে রান্না করার সময় কম। কিন্তু এই ক্যান্টিন আসলে সবার জন্য উন্মুক্ত।’

গত ১৬ আগস্ট ভারতের ৭০তম স্বাধীনতা দিবসের দিন কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধী বেঙ্গালুরুতে এই ক্যান্টিন উদ্বোধন করেন। সেসময় তিনি বলেন, মানুষকে ক্ষুধা থেকে মুক্ত করাই এই ক্যান্টিনের লক্ষ্য।

ইন্দিরা ক্যান্টির উদ্বোধনর দিন সেখানে খাবার খান রাহুল গান্ধী। সংগৃহীত ছবি
ইন্দিরা ক্যান্টির উদ্বোধনর দিন সেখানে খাবার খান রাহুল গান্ধী। সংগৃহীত ছবি

পুরো বেঙ্গালুরু জুড়ে এরকম ১৫২টা ক্যান্টিন রয়েছে। আর এসব ক্যান্টিন থেকে প্রতিদিন দুই লাখ মানুষের খাবার দেওয়া হয়। নভেম্বরের মধ্যে ক্যান্টিন সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৮ করা হবে। তখন প্রতিদিন তিন লাখ মানুষের খাবার দেওয়া যাবে। আর জানুয়ারিতে এই প্রকল্প রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে দিতে তৈরি হবে ৩০০ ক্যান্টিন।

দুপুরের খাবার সময় হতেই আবার রওনা দেওয়া গেলো অন্য একটি ইন্দিরা ক্যান্টিনের সামনে। মারকাম রোডের এই ক্যান্টিনে ভিড় একটু কম হলেও এখানে আছেন মূলত অফিসকর্মী আর ছাত্ররা।

শাকসবজি আর মসুর ডাল দিয়ে রান্না সাম্বার খিচুড়ি খেতে মোটেই খারাপ নয়। ভারতের জনপ্রিয় একটি লোকশ্রুতি হচ্ছে, ‘পেটের মধ্য দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছে যাও।’ রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস ভোটে জিততে হয়তো এই আশাই করছে।

রাতের খাবার খেতে বসা ভেঙ্কটেশ নামের এক ব্যক্তি গীতা পান্ডেকে বলছিলেন, নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে গেলে হয়তো এই ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তবে মনোজ রাজন জানিয়েছেন, ‘কংগ্রেস হেরে গেলেও নাগরিক উদ্যোগে এই প্রকল্প চালু রাখা হবে। মানুষের ক্ষুধা মেটানোর জন্য সরকারে থাকার দরকার পড়বে না।’