কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: নূর, প্রিয়.কম।

‘প্রকাশ্যে না চেয়ে যদি গোপনে শেখ হাসিনার কাছে পুরস্কার চাইতাম, সেটা কি ভালো হতো?’ 

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ২১:২৫
আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ২১:২৫

(প্রিয়.কমবাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও আধুনিক কবি নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৪৫ সালের ২১ জুন, নেত্রকোণায় জন্ম নেন এ খ্যাতিমান কবি। নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলায় কাটে তার দুরন্ত শৈশব। চার বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ আবার বিয়ে করেন। ঘরে আসে নতুন মা চারুবালা।

৬৬’ এর ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন এ কবি; এরপর বাদ পড়েনি স্বাধীনতার পূর্বে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো বিপর্যয়, যতবার এ রাষ্ট্র বিপথগামী হয়েছে- কলম ধরেছেন তিনি, লিখেছেন একের পর এক শ্রেণী সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার-বিরোধী কবিতা। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতার কবি তিনি, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কলম তিনিই ধরেছেন। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।

তার কবিতার আরকটি প্রধান আলোচ্য বিষয় নারী ও প্রেম। বিভিন্ন কবিতায় নারী-পুরুষের প্রেম গভীরভাবে ব্যক্ত করেছেন তিনি। তবে তার ভাষ্যমতে- আমরা যে ভূখণ্ডে বাস করছি; সেখানে বাস করা এত বেশি সংগ্রামের যে প্রেমিকাকে খুব বেশি সময় দিতে পারেননি তিনি, আর তাই হয়তো প্রেমিকাও তাকে বলার সুযোগ পাননি- ‘তোমার চোখ এত লাল কেন’? বোহেমিয়ান জীবন যাপনে অভ্যস্ত নির্মলেন্দু গুণ নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই প্রকৃত কবির জীবন যাপন করে গিয়েছেন; এর জন্য আশ্রয় নেননি কোনো ছল-চাতুরীর, আর তাই স্বাধীনতা পুরস্কারটি এ রাষ্ট্রের কাছে তাকে চেয়ে নিতে হয়েছিল। স্বাধীনতা পুরস্কার চেয়ে নেওয়ার মতো সাহসীকতা এ রাষ্ট্রে বোধহয় তাকেই মানায়।

সম্প্রতি রাজধানীর কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামের নিচ তলায় কবির নিজস্ব বইয়ের দোকান ‘কাঁশবন’এ বসে তিনি কথা বলেন প্রিয়.কম এর সঙ্গে। কবির সাথে কথোপকথনের সেই মুহূর্তগুলো প্রিয়.কম এর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো-

প্রিয়.কম: দাদা, প্রথমে এই দোকান সম্পর্কে জানতে চাই। সম্প্রতি এটি আপনি দিয়েছেন, দেখতে পাচ্ছি এখানে সবই আপনার বই…

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, এ দোকানটি এ মাস থেকেই আমি নিয়েছি। এটা আসলে ‘কাঁশবন’ নামের একটি ছোট পত্রিকার অফিস ছিল। ওরা আমার উপর একটা বিশেষ সংখ্যা করেছিল প্রায় ৩০০-৪০০ পৃষ্ঠার, তারপর আমাদের সদ্য প্রয়াত কবি রফিক আজাদের উপরও খুব বড় একটা সংখ্যা করেছে। এই দুটি সংখ্যা করার কারণে কাঁশবন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকায় চলে গিয়েছে। কিন্তু এ দোকানটা ওরা তেমন ব্যবহার করছিল না, ফলে আমি ওদের বললাম- যেহেতু তোমরা দোকানটা তেমন ব্যবহার করছো না, আমাকে দিয়ে দাও। আমার তো একশর উপরে বই আছে, অনেক পাঠক সন্ধান করে বইগুলো খুঁজে পায় না। বিভিন্ন সময় অনেকে আমার কাছে ফোন করে জানতে চায় কোথায় পাওয়া যাবে। আমি তখন আজিজ মার্কেট, নিউ মার্কেট এগুলোর কথা বলি, তবুও অনেক জায়গায় বই পাওয়া যায় না। তখন আমার মাথায় চিন্তা এলো আমি যদি একটি বইয়ের দোকান দিই, যেখানে আমার সব বই এক সাথে পাওয়া যাবে একটা জায়গাতেই, তাহলে আমার একটা ব্যবসায়িক লাভও হলো, আবার সেখানে আমি দুইটা ছেলেকে প্রোভাইডও করতে পারব। আমার অবর্তমানে আমার বইগুলোর তদারকি তারা করতে পারবে। আমরা স্ট্যাটাসের (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) মাধ্যমে এই দোকানের কথা প্রচার করে দিতে চাই। আজকেই একটা স্ট্যাটাস দিয়েছি। সপ্তাহে তিন দিন আমি এখানে বসব। আমাকে সন্ধান করার জন্য এখন আর কষ্ট করে কামরাঙ্গীর চর যেতে হবে না, কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামের কাঁশবনেই রাত আটটার পর আমাকে পাওয়া যাবে। পাঠকরা ইচ্ছা করলে আমার অটোগ্রাফ যুক্ত বইও কিনতে পারবেন, আমার সাথে সেলফিও তুলতে পারবেন। ফলে আমি সহজলভ্য হব এবং আমার বইও আগের চেয়ে সহজলভ্য হবে।

প্রিয়.কম: আপনার এই প্রতিষ্ঠান থেকে কি বই প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছা আছে?

নির্মলেন্দু গুণ: না, বই প্রকাশের চিন্তা নাই। আমার তো একশজন প্রকাশক আছে, সুতরাং আমি আর নিজে প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে নাক গলাতে চাই না। একবার এক প্রকাশক আমার একটা বই প্রকাশ করা নিয়ে বিলম্ব করছিল, তখন আমি ঐ বইটা নিজেই প্রকাশ করে ফেলেছিলাম, সেটার নাম দিয়েছিলাম ‘অগত্যা প্রকাশনী’! পরে অবশ্য সেটা বিক্রেতাদের দিয়ে দিয়েছি, তুমি বলাতে বই প্রকাশনার সেই ঘটনা মনে পড়ল।  

প্রিয়.কম: তাহলে দাদা; এখন একটু আগে থেকে জানতে চাইব, মানে আপনার ছেলেবেলা, নেত্রকোণার জীবন আরকি...

নির্মলেন্দু গুণ: নেত্রকোণার আগে তো আর যেতেও পারবা না! তুমি ইচ্ছা করলেও এর আগে যেতে পারতেছ না!

প্রিয়.কম: সেটাই। আপনার ছেলেবেলা কেমন কেটেছে?

নির্মলেন্দু গুণ: এই শোনো, তার আগে তোমারে একটা গল্প বলি…

প্রিয়.কম: বলুন…

নির্মলেন্দু গুণ: আগে যখন বাংলা একাডেমীতে বইমেলা হতো, আমরা কয়েকজন স্টলের মধ্যে বসতাম। কিছু ছেলেপেলে আসতো; হয়তো স্কুলে পড়ে, নাম শুনেছে বা টেলিভিশনে আমার চেহারাটা দেখেছে। তাদের হয়তো আমার আর রবীন্দ্রনাথের বয়সের পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নাই। নজরুল বড় না, মাইকেল মধুসূদন বড় সেটাও হয়তো তারা স্পষ্ট জানে না। আমাকে একবার এদের মধ্যে কয়েকজন জিজ্ঞেস করছে- আচ্ছা, আপনি কি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন? আমি বললাম, না! রবীন্দ্রনাথকে আমি দেখি নাই, আমার সে সৌভাগ্য হয় নাই কারণ রবীন্দ্রনাথ আমার জন্মের আগে মারা গেছেন। আমি আবার ওদের জিজ্ঞেস করলাম রবীন্দ্রনাথ কত সালে মারা গেছেন তোমরা সেই সম্পর্কে কিছু জানো? বললো যে, না। এটা আমাদের ছেলেমেয়েদের জ্ঞানের স্বল্পতা। কিছুক্ষণ পর ঘুরে এসে আবার জিজ্ঞেস করলো- আপনি কি মাইকেল মধুসূদনকে দেখেছেন? আমি বললাম মাইকেল মধুসূদন তো রবীন্দ্রনাথেরও আগের কবি। তোমরা শুধু নামগুলোই জানো, তাদের জন্ম তারিখ সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণা নাই। এরপরে আবার বলে, আপনি কি নজরুলকে দেখেছেন? মানে বুঝছো তো? তারা জানতে চাইছে, আমি তো কবি, কিন্তু কোনো বড় কবির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে কি না! আমি তখন বললাম- হ্যাঁ, নজরুলকে দেখেছি। নজরুল পিজি হাসপাতালে যখন চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন আমি উনার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন আমি ওদের পরামর্শ দিলাম, তোমরা একটা কাজ করবে- যেই লেখকের সম্পর্কে তোমাদের আগ্রহ হবে, তার জন্ম সাল-তারিখটা জেনে রাখবে, তাতে তোমরা ধারণা পাবে কে বয়সে কার চেয়ে বড়। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কি-না; তিনি মারা গেছেন ১৯৪১ সালে, আমার জন্ম ১৯৪৫ সালে। তার মৃত্যু এবং আমার জন্মের মাঝখানে যে চার বছর- সে সময় কী হয়েছে সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। ঐ সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কি-না সেটা আমার অজানা! 

প্রিয়.কম: যেটা বলছিলাম দাদা, আপনার ছেলেবেলার কথা...আমি জানি যে খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন আপনি।

নির্মলেন্দু গুণ: আমার বয়স তখন চার হয়নি বোধহয়, চারের কাছাকাছি। আম্মা অসুস্থ ছিলেন, বাবা তার মাথার পাশে বসে আম্মার মাথায় জল ঢালছিলেন। আম্মা করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি তখন একটা প্লাস্টিকের ফুটবল নিয়ে বাইরে খেলতে যাচ্ছিলাম, ওই সময় বাবা ডেকে মায়ের পাশে বসতে বললেন। আমি এই প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমি মাকে এক ঝলক দেখলাম। মাও চেয়েছিলেন হয়তো আমাকে ছুঁয়ে দেখবেন, তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে এই বোধটা হয়তো তিনি টের পাচ্ছিলেন। তখন তো আর এগুলো বুঝতে পারিনি। এখন ভাবতে কষ্ট হয়, আমাকে শেষবার স্পর্শ করার যে ইচ্ছা তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল সেটা আমি হতে দিইনি। হাতের বলটি নিয়ে আমি দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার মনে হচ্ছিল- ফুটবল খেলার সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু মা তো আর চলে যাবে না। এই চলে যাওয়াটার সঙ্গে তো আমি পরিচিত ছিলাম না। মৃত্যুর সঙ্গে ঐ প্রথম আমার পরিচয় হলো। আমার ধারণার মধ্যেই ছিল না মা মরে যেতে পারেন। এই বোধই ছিল না আমার ভেতরে। তারপরে আমার আর কিছু মনে নেই। আমি অনুমান করি যে- ঐ দিনই কিছুক্ষণ পরে মা মারা গিয়েছিলেন। আমার জ্যেঠি মা, কাকী মা, আমার বড় বোনেরা, আত্মীয়স্বজনরা আমাকে খেলার মধ্যে থেকে নিয়ে এসেছিলেন, আমি কিছুতেই আসতে চাচ্ছিলাম না। তারা জোর করে নিয়ে আসছিলেন, আমি কি কান্না করব! আমার নির্বিকার মূর্তি দেখে তারাই কান্নাকাটি করছিলেন। আমাকে তারা বুঝাতে চেষ্টা করছিলেন যে আমার মা মারা গেছেন, কিন্তু এই মারা যাওয়া জিনিসটাই তো আমার বোধের মধ্যে তখন ছিল না। কিন্তু এখন যখন আমি আমার অতীতকে রোমন্থন করি তখন মায়ের ঐ শুয়ে থাকার দৃশ্যটিই আমার কাছে তাকে নিয়ে একমাত্র স্মৃতি বলে মনে হয়। এর আগে তাকে কখনো দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। তাকে কখনো ঘরে বসে থাকতে বা ঘরে হাঁটাচলা বা পায়চারী করতে, কোথাও দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেছি বলে আমার স্মৃতির মধ্যে নেই। মনে থাকার মধ্যে মা শুয়ে আছেন, বাবা তার মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছেন- এই দৃশ্যটুকুই শুধু মনে আছে।

প্রিয়.কম: আপনার আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার ছেলেবেলা’তেও বোধহয় মায়ের মৃত্যুর সেই দৃশ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন?

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ। ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটা শুরুই হয়েছে মায়ের মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে। ম্যাক্সিম গোর্কির ছেলেবেলা, রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা, বুদ্ধদেব বসুর ছেলেবেলা- এই সবগুলো বই-ই আমি পড়েছিলাম। এর মধ্যে আমার সব থেকে ভালো লেগেছিল ম্যাক্সিম গোর্কির ছেলেবেলা। তার জীবনের মধ্যে এক বিরাট সংগ্রাম ছিল। জন্মের পরেই তার পিতা মারা যান, তাকে তার দিদি মা মানুষ করেছিলেন। মামার বাড়িতে তিনি বড় হয়েছিলেন, কিন্তু তার লেখার ভেতরে দিদি মা’র চরিত্রটি খুব সুন্দরভাবে এসেছে। লেখার মধ্যে তার জীবনের যে সংগ্রাম পেয়েছিলাম, ঐটা আমাকে খুব আকর্ষিত করেছিল। আমার আত্মজীবনী যখন আমি লেখা শুরু করি, আমার বোধহয় তখন ৪২ বছর বয়স। ৪২ বছর বয়সে আমি ছেলেবেলার বইটি লিখেছি। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তার ছেলেবেলার বইটি লিখেছিলেন সত্তর বছর বয়সে, বুদ্ধদেব বসু সম্ভবত ষাট বছর বয়সে। আমি চিন্তা করে দেখলাম-ছেলেবেলার গল্প লেখার জন্য এত দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করার কিছু নাই। রবীন্দ্রনাথের আগে বোধহয় কেউ ছেলেবেলা লিখেননি, এই ধারণাটাই হয়তো ছিল না তখন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনেক নতুন ধারণার সাথে পরিচয় করিয়েছেন। তার দাদা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিন্তু তার আত্মজীবনী রচনা করে গেছেন। সুতরাং আত্মজীবনী রচনার ধারণা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন দাদার কাছ থেকে, কিন্তু ছেলেবেলাকে পৃথক করে লেখার ধারণাটা বাংলা সাহিত্যে আগে ছিল না। ফলে রবীন্দ্রনাথের আগে কারো ছেলেবেলার বই আমরা পাই না। এগুলো পড়ার পর তাই আমি চিন্তা করে দেখলাম, ষাট-সত্তর বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই, স্মৃতি সতেজ থাকতে থাকতেই ছেলেবেলার ঘটনাগুলো আমার লেখা দরকার। যেহেতু আমি মনে করেছি যে লিখব; এবং আমার লেখা সম্পর্কে পাঠকদের কৌতূহল সৃষ্টি হবে, সুতরাং তা আগেই লিখে ফেলা ভালো। এই বই লেখার সময় শুরুটা কোন জায়গা থেকে করব এটা ভাবতে গিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কির ছেলেবেলার লেখাটা মনে পড়ল। তার বইটি একটি করুণ দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল- যা তার জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে, এ ঘটনা তার জীবনের অনেক কষ্টের কারণও হয়েছিল। তিনি সেই কষ্ট জয় করে কীভাবে বড় লেখকে পরিণত হলেন, সেই অভিজ্ঞতাটা যেহেতু তার বই থেকে আমি পেয়েছি, ফলে আমি ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটি মায়ের মৃত্যুর দৃশ্য দিয়েই শুরু করেছিলাম।

প্রিয়.কম: মায়ের মৃত্যুর পর আপনার অনুভূতি কী রকম ছিল? বুঝতে নিশ্চয় সময় লেগেছিল?

নির্মলেন্দু গুণ: আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি আমার মা মারা গেছেন। মাকে দেখি না দেখি না... এত ছোটবেলার কথা মানুষের মনে থাকারও কথা না, আমার মনে হয় পাঁচ-ছয় বছর বয়সের আগের কথা মানুষের মনে থাকে না। সম্ভবত এটা একটি বিশেষ ঘটনা বলেই আমার চোখে দৃশ্যটা রয়ে গেছে। শামসুর রাহমানের একটা কবিতা আছে- ‘কখনো আমার মাকে’, যদিও শামসুর রাহমানের মা খুব দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। শামসুর রাহমান যখন প্রায় পঞ্চাশ বছরের, তখন মায়ের সাথে তার একটা ছবি আছে। মা তাকে আদর করছেন। তবুও তিনি তার মাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, সে কবিতার শুরুতেই আছে- ‘কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি’। আমার কাছে মনে হয়, তার এই কবিতাটি আমার মায়ের বেলায় সত্য। আমাদের কিছু পারিবারিক ছবি আছে; সেই ছবিগুলোতে দেখা যায় আমি মায়ের সামনে বসে আছি। আবার আমার ছোট বোনকে নিয়ে মা আদর করছেন, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছি। মা’র একার ছবিও অনেক দেখেছি। তখন আমাদের বাড়িতে ছবি তোলার একটা রেওয়াজ ছিল। আগের দিনের মানুষের তো একটা সমস্যা ছিল যে তারা জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতির সাথে পরিচিত ছিল না, ফলে আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের মা ১৩-১৪টা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, আমার মাও খুব অল্প দিনে অল্প বয়সের ব্যবধানে অনেকগুলো সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। আমার একটা বড় ভাই ছিলেন কালীদাস নামে, খুব অল্প বয়সেই তিনি মারা যান। ‘কালীদাস’ নামটি আমার বাবার রাখা। আমি মনে করি কালীদাসের নামে নাম রাখার কারণ- আমার বাবা হয়তো চেয়েছিলেন তার কোনো এক সন্তান কবি হোক! নাহলে কালীদাসে নামে নাম রাখবেন কেন?

প্রিয়.কম: আপনার বাবা তো আর্ট-কালচারের সাথে জড়িত ছিলেন বলে শুনেছি...

নির্মলেন্দু গুণ: তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তিনি সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হতো। আমার জ্যাঠা, কাকা বা আমার ঠাকুরমা এটার পক্ষপাতী ছিলেন না, ফলে ঠাকুরদাদা মারা যাওয়ার পর বাবাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হলো। বাবাকেও আর্ট স্কুলে পড়াশোনা শেষ না করেই ফেরত আসতে হয়েছিল।

প্রিয়.কম: আপনি তো ছবিও আঁকেন, ছবি আঁকার ইচ্ছাটা কীভাবে হলো?

নির্মলেন্দু গুণ: আমাদের একটা স্বচ্ছল পরিবার ছিল, যেখানে ছবি আঁকা বা তোলার একটা রেওয়াজ চালু ছিল। আমার ঠাকুরদাদা যখন বেঁচে ছিলেন তখন টেকনোলজি এত উন্নত ছিল না, যার ফলে ১৯১৩ সালে তিনি তার একটা পোট্রেট আঁকিয়েছিলেন শারদা রায় নামের একজন শিল্পীকে দিয়ে। আমি আমার গ্রামে ঠাকুরদাদার (রামসুন্দর পাঠাগার) নামে যেই পাঠাগার করেছি, সেখানে ঐ তৈলচিত্রটি আছে। ১৯১৩ সালে করা তার ওই পোট্রেট আমি সারা বাংলায় আর একটাও দেখিনি। এত সুন্দর পোট্রেট ছিল ঐটা। গ্রামে আমি একটি আর্ট স্কুল করেছি শারদা রায়ের নামে (শারদা বসু দেব চিত্রশালা)। তিনি পরবর্তীতে তার কন্যাকে আমার জ্যাঠা মশাইয়ের সঙ্গে বিবাহ দেন। আমরা বাঙালিরা চিত্রকলার চর্চার সময়টাকে রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই ধরতে চাই; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬-২৭ সাল থেকে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন, তার আগে থেকেই কিন্তু আমাদের পটচিত্রে এগুলো পাওয়া যেত। গ্রামের কুমার ছিলেন যারা, দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করতেন, মূর্তি তৈরির আগে তারা কাগজে নকশা তৈরি করে নিতেন। বিক্রমপুরে শম্ভু আচার্য্য ছিলেন তিনি যে পটচিত্র তৈরি করেছেন সেগুলোও আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আধুনিক চিত্রকলার চর্চা যেমন তৈলচিত্র- ১৯১৩ সালে শারদা রায়ের করা আমার ঠাকুরদাদার পোট্রেটটির আগে সারা বাংলাতেই কখনো কোনো শিল্পী করেছেন বলে আমার মনে হয় না। আমি আমার একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে যদি কোনো শিল্পীর আঁকা ১৯১৩ সালের কোনো তৈলচিত্র দেখাতে পারেন তাহলে আমি খুশি হবো, আমার এই ধারণাটার পরিবর্তন হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে দেখাতে পারেননি, দাবিও করতেও পারেননি। ঐ তৈলচিত্রটি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। আর আমার বাবা নিজেও তো ছবি আঁকতেন, ফলে তার উত্তরাধিকার সূত্রেও এটা পাওয়া বলতে পারো। 

প্রিয়.কম: মায়ের মৃত্যুর পর তো আপনার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। কেমন ছিল নতুন মায়ের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা?

নির্মলেন্দু গুণ: মা যে মারা গেছেন আমি তো বুঝতে পারিনি, অন্যরা আমাকে বলত, আমাকে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করত। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না মা মারা গেছেন, আমার ধারণা ছিল মা কোথাও বেড়াতে গেছেন। ফলে আমি কোনোদিন মায়ের জন্য কান্নাকাটি করেছি এ রকম স্মৃতি আমার মনে নেই। অন্যরাও পরবর্তীতে কেউ বলেননি যে মায়ের মৃত্যুতে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। জিনিসটা আমি বুঝতেই তো পারিনি। আমার একটা কবিতা আছে ‘নিজের ঘরে আগুন’, সেই কবিতার মধ্যে এর বর্ণনা আছে, আমি যে মাকে মুখাগ্নি করেছি, তার মৃতদেহে আগুন দিয়েছি, আমি যে এত বড় একটা সর্বনাশ করেছিলাম- সেটা আমার স্মৃতিতেই নেই। ফলে আমার দ্বিতীয় মা যখন আমাদের সংসারে আসলেন, তাকে দেখে আমার মনে হলো- আগের মায়ের থেকে এ মা একটু মেদবহুল, স্বাস্থ্য ভালো, বয়স একটু কম মনে হয়েছে, রুগ্ন মনে হয় না। আমার মনে হয়েছে আমার মা-ই বোধহয় চিকিৎসার জন্য বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরে এসেছেন। উনাকে কখনোই আমার মনে হয়নি যে- তিনি আমার মা নন। ফলে আমার একটা কবিতা আছে, এই মা মারা যাওয়ার পরে লিখেছিলাম- ভুলেই হয়তো কিন্তু আমি তো তোমার নিজের সন্তানরা জন্মের আগেই তোমাকে মা ডেকেছিলাম। আমি তো তোমার গর্ভজাত সন্তান না, কিন্তু তোমার গর্ভজাত সন্তান এবং আমার ভাই-বোনদেরও আগে আমি তোমাকে মা ডেকেছিলাম। এটাই আরকি। তার সাথে আমার সম্পর্ক সব সময়ই খুব ভালো ছিল। আমি কখনোই তাকে বিমাতা হিসেবে দেখিনি, তিনিও আমার সাথে কখনোই বিমাতাসুলভ আচরণ করেননি। এটা আমার কখনোই মনে হয়নি যে নিজের মা না থাকার কারণে তিনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। বরং সব সময় বাজার-সদাই করা, দোকান থেকে এটা-সেটা আনতে তাকে আমি সাহায্য করেছি। কিন্তু আমার যে বড় ভাই; তিনি তো তখন আমার থেকে অনেক বড়, নতুন মায়ের সাথে এডজাস্ট তিনি করতে পারতেন না। ফলে রাগ করে ভারতে চলে গিয়েছিলেন।

প্রিয়.কম: ছাত্র হিসেবে তো আপনি দুর্দান্ত ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটে নেত্রকোণা কলেজ থেকে আপনি একাই প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে সুযোগ পেয়েও ভর্তি হতে পারেননি… 

নির্মলেন্দু গুণ: সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু ৬৪’ সালে কিন্তু একটা বিরাট দাঙ্গা হয়েছিল। সেই দাঙ্গাটা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, মানিকগঞ্জসহ ঢাকার আশেপাশের এলাকায় এ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকার ভেতরেও পুরনো ঢাকা, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীপট্টিতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন হিন্দু ছাত্ররা বসবাস করতো জগন্নাথ হলে, হল আক্রমণ হতে পারে এ রকম আশঙ্কায় হল কর্তৃপক্ষ একদিন রাতে হল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। আমার এক পিসতুতো ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামিস্ট্রিতে পড়ত, তিনিও জগন্নাথ হলে থাকতেন। আমি ঢাকায় এসে তার রুমেই উঠেছিলাম। হল বন্ধ করে দেওয়ার পর আমরা রাতে পালিয়ে তার বাড়ি গফরগাঁও’য়ে চলে যাই। রাতে সেখানেই থাকি। কিন্তু দাঙ্গার ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়তে থাকে, তখন আমরা স্থির করি যে ঢাকাতে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। পরে আমি নেত্রকোণাতেই ফিরে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমার বাবা আর কিছুতেই ঢাকাতে ফেরার ব্যাপারে রাজি ছিলেন না। ভারতে চলে যাওয়ার জন্য পারিবারিকভাবে একটা চাপও ছিল। আমার যে বড় ভাই ভারতে চলে গিয়েছিলেন, তিনিও সেখান থেকে চিঠি দিচ্ছিলেন যেন তার কাছে চলে যাই। আমি একটা দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। কবি হব এটা তো তখনো ভাবিনি। ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। অন্যদের মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে যে ভাবনা থাকে, আমার মধ্যেও তাই ছিল।

প্রিয়.কম: আপনার বাবার তো ইচ্ছা ছিল আপনি ডাক্তার হবেন...

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, বাবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু আমার সেদিকে আগ্রহ ছিল না। সেবারই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বিভাগ চালু করা হয়। মাত্র ৩৫ টা আসন সংখ্যা ছিল সেখানে। এই পঁয়ত্রিশ জনের মধ্যে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা মিলে আমার স্থান ছিল একাদশ। সো আই ডিড ওয়েল। যেহেতু ঐটা একটা নতুন সাবজেক্ট, ফলে ঐ সাবজেক্টে পড়ার জন্য ইন্টারমিডিয়েটে যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি থেকে শুরু করে সকলেই বেশ উদগ্রীব ছিলেন। দাঙ্গার ভয়াবহতা কমলে আমি যখন ঢাকায় ফিরলাম, তখন এসে দেখি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়েছে।

প্রিয়.কম: নাম কেটে দেওয়ার কারণ কী ছিল? সাম্প্রদায়িকতার কারণে?

নির্মলেন্দু গুণ: অবশ্যই। এছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? এরপর ১৯৬৫ সালে আমি আর কী করব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ভর্তি হতে পারলাম না। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পেয়েছিলাম, ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং এ চেষ্টাও করিনি। তখন মেডিকেলে পড়ার জন্য সেকেন্ড ডিভিশন ওয়াজ গুড। আমাদের সময় সমগ্র ঢাকা বোর্ড থেকে ১১৯ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল। এই ১১৯ জনের মধ্যে আমি একজন। মেডিকেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে প্রথম বিভাগ পাওয়া কোনো শিক্ষার্থীরাই বাদ যায়নি, সবাই চ্যান্স পেয়েছে। আমিই শুধু ঐ বছর বাদ পড়েছিলাম, ভর্তি হতে পারিনি। আমার ভবিষ্যত স্বপ্নকে এ ঘটনা খুবই আহত করে। ফলে পড়াশোনার প্রতি আমার আগ্রহ কমতে থাকে। পরের বছর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে আর্কিটেকচারে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এক বছর পড়াশোনা কেন করিনি এটা আমাকে সেখানে ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম। ফেল করার কথা আমার মাথায় কখনো আসেইনি। ফেল যে করা যায়, এ ধারণা আমার ভেতরে ছিলই না কখনো। আমি কিন্তু পরে বি.এস.সিতে দুইবার ফেল করেছিলাম! একবার হলো কি, মাননীয় রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি কলেজ জীবন থেকে আমার ভীষণ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তো মাননীয় রাষ্ট্রপতি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি কীভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী হলাম। আমি তাকে উত্তর দিলাম- ইট ওয়াজ নট বাই মাই চয়েজ, ইট ওয়াজ অ্যা নেচারাল ফ্রেন্ডশিপ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কে কে ভর্তি হচ্ছে তা তো আমি জানতাম না। আমি ক্লাসে গিয়ে একদিন আবিষ্কার করলাম শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের সহপাঠী। আমি তখন রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে বললাম যে- স্যার, আমি তো দুইবার বি.এস.সি ফেল করার পর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন উনি আমাকে বললেন- ‘ও! আপনি দুইবার ফেল করছিলে...ন? আমি তিনবার! আমরা ফেল করছিলাম বইলাই তো বাংলাদেশ পাশ করল’! জীবনের উপর আসলেই সে ঝুঁকি নিতে হয়। আমরা সে ঝুঁকি নিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দাবি পেশ করলেন, তারপরে আর আমাদের মনের ভেতর পড়াশোনা করে বড় হওয়ার আগ্রহটা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি বাস্তবায়িত হলে আমাকে যে সাম্প্রদায়িকতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি, এ পরিস্থিতি থেকে অন্তত পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তি পাবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তো অন্তত এটুকু নিশ্চিত হয়েছে, তাই না? এখন বহু হিন্দু ছেলে মেডিকেলে পড়ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ভারত থেকে পড়াশোনা করে আবার দেশে ফিরছে। আগে একটা কথা ছিল যে হিন্দুরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ভারতে চলে যায়, সুতরাং স্টপ দেম। তাদেরকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে আমাদের রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়। আমাকে কিন্তু এ কারণেই বুয়েটে পড়তে দেওয়া হলো না। লিখিত পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়ার পর মৌখিকে জিজ্ঞেস করা হলো- ভারতে আমার কে আছে? আমি বললাম যে আমার বড় ভাই আছে। এরপরে তারা আমাকে আর কোনো প্রশ্নই করেননি। যেহেতু আমার বড় ভাই সেখানে আছেন, তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে আমিও চলে যাব। প্রশ্ন যেহেতু করেননি, আমি ধরে নিয়েছিলাম লিখিত পরীক্ষায় টিকেছি, ফলে ভর্তি হতে পারব। কিন্তু ফলাফল বের হওয়ার পর দেখলাম যে আমার নাম নেই।

প্রিয়.কম: ছয় দফা আন্দোলন তো খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সেই আন্দোলনে উজ্জীবিতও হয়েছেন...

নির্মলেন্দু গুণ: এই যে সাম্প্রদায়িক একটা পরিস্থিতি দেশে বিরাজমান ছিল, এর থেকে উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম। আমি যেহেতু কবি ছিলাম, তাই হয়তো আমার ভাবনা দূরদর্শিতা সম্পন্ন ছিল। আমি স্বপ্ন দেখতাম- স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ হলে, এর নিয়ন্ত্রণ বাঙালিদের হাতেই চলে আসবে শেষ পর্যন্ত, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ফলে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি; সেই স্বাধীনতা হয়তো এত কষ্টের বিনিময়ে অর্জন করতে হতো না- যদি ছয় দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার পেতেন। তিনি সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও পাকিস্তানিরা তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। বঙ্গবন্ধু পাশ করার পর রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট নৌকা বানিয়ে সেখানে ১৬৬ জন সংসদ সদস্য নিয়ে তিনি একটা মিটিং করেছিলেন, সেই মিটিং এ তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘ছয় দফার সঙ্গে যদি কেউ বেঈমানি করে, তবে তাকে এই উদ্যানে জ্যান্ত কবর দেবেন। শেখ মুজিবুর রহমানও যদি করে, তাকেও ছাড়বেন না, তাকেও এখানেই কবর দেবেন’। ছয় দফাই হচ্ছে আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ, এই ছয় দফার পক্ষেই বাংলার মানুষ রায় দিয়েছে। সুতরাং এর সাথে কোনো আপোষ নেই। পরবর্তীতে কিন্তু ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর সাথে যে আলোচনা হলো, সেখানে ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন না করার জন্য বঙ্গবন্ধুর উপর তারা চাপ সৃষ্টি করেন। বলা হয়েছিল ছয় দফা থেকে সরে এসে তুমি যদি পাকিস্তানের সাথে সংবিধান প্রণয়ন করো, তাহলে প্রধানমন্ত্রী করে তোমার কাছে আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করব। ইনফ্যাক্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে সম্বোধনও করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই’। এ আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে আমি যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর এ স্বপ্নের সঙ্গে আমার স্বপ্ন মিশে গিয়েছিল।

প্রিয়.কম: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতাও তো আপনার লেখা...

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, আমিই ১৯৬৭ সালে তাকে নিয়ে প্রথম কবিতাটা লিখেছিলাম। আমার আগে কেউ বঙ্গবন্ধুকে কবিতার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন নাই। তার পরবর্তীকালে উনি যখন নির্বাচনে জয় লাভ করলেন, তখন জসীম উদ্দীন সাহেব তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি তো বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। সিকান্দার আবু জাফর, সুফিয়া কামালসহ আরো অনেকেই পরে তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আমি লিখেছিলাম সবচেয়ে আগে। ১৯৬৭ সালে। যখন ছয় দফা আন্দোলনের সময় তাকে কারাবন্দি করা হয়েছিল, তিনি জেলখানায় ছিলেন এবং আওয়ামীলীগের প্রায় হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মুক্তির জন্য ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সারাদেশে হরতাল ডাকা হয়েছিল। সে হরতালে এগারজন প্রাণ দিয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। তারাই ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। তখন আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম (‘প্রচ্ছদের জন্য’), সে কবিতা ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সব লাইন তো মনে নেই, কয়েকটা লাইন এ রকম ছিল- ‘শীতের রোগীর মতো জবুথবু নয়/ গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে/রক্তের রঙ দেখে ভয় নেই/স্বাধীন দেশের মুক্ত জনতা উল্লাস করো সবে’।

প্রিয়.কম: ইন্টারমেডিয়েটে পড়ার সময় থেকে নাকি আপনার জুয়া খেলার অভ্যাস হয়েছিল?

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ। আমার আত্মজীবনীমূলক বইয়ে এ বিষয়টা আমি অকপটে স্বীকার করেছি। আমি যে হোস্টেল রুমে জুয়া খেলতাম, এটা আমার হোস্টেল সুপার গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলেন। একদিন খেলছিলাম কয়জন বন্ধু মিলে, তিনি এসে হঠাৎ করে দরজায় কড়া নাড়লেন। আমরা ভেবেছি আমাদের সাথে খেলার জন্য এক বন্ধুর মুসলিম হোস্টেল থেকে আসার কথা, সে বোধহয় এসেছে। ফলে আমরা খুব সানন্দেই দরজা খুলে দিয়েছি। আমাদের বিছানার উপর তাস ছড়ানো, টাকা পয়সাও ছড়ানো ছিল। স্যারকে দেখে তো সবাই দৌড়। তিনি খুব কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন। পরে তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। শুনেছি সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু আমাকে খুবই অপছন্দ করতেন। আমাকে বলতেন- ‘মোস্ট ডিস্টার্বিং বয় ইন দ্য হোস্টেল’! অবশ্য যুক্তিসংগত কারণেই আমাকে অপছন্দ করতেন। ফাস্ট ডিভিশন পাওয়া ছাত্র আমি, অথচ ছাত্রদের মধ্যে জুয়া খেলার প্রচলন আমিই শুরু করি- সেটা তো তার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তিনি আমাকে হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করে দিলেন। শুধু বহিষ্কার করেই ক্লান্ত হননি, আমাকে শাসিয়েও ছিলেন- কীভাবে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় পাশ করি, তিনি দেখে নেবেন। পরে দেখলাম এই কলেজে থাকলে আমার পাশ করা কঠিন হবে। তখন আমি ওই কলেজ থেকে টি.সি নিয়ে নেত্রকোণায় চলে গেলাম। পরীক্ষার মাস ছয়েক আগে নেত্রকোণা কলেজে গিয়ে ভর্তি হলাম, সেখান থেকেই আইএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এই কথা আমার আত্মজীবনীতে লেখার পরে তিনি কীভাবে জানি জানতে পেরেছিলেন। প্রায় ত্রিশ বছর পর একবার আমার বাসায় আসলেন। এই ত্রিশ বছরে কিন্তু তার সঙ্গে আমার দেখা-ই হয়নি। তিনি এসে আমাকে বললেন- ‘তুমি এসব কথা লিখছো কেন’? আমি বললাম যে স্যার সত্য কথা লিখছি। উনি পরে বললেন- ‘তুমি মনের থেইকা আমার উপর কোনো রাগ পোষণ করো না, আমি কষ্ট পেয়েছি যে তুমি আমার অত্যাচারে কবি হইছো এই কথা বলছো’। আমি বলেছি, এটা ভালো তো। কারো না কারো অত্যাচারে যদি অন্য কারো পুনর্জন্ম হয়, সেটাতে মন্দ কি? আমি তো খারাপ কিছু লিখি নাই। স্যার, এ ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা বিব্রত ছিলেন।

প্রিয়.কম: জুয়ার এই অভ্যাসটা কি দীর্ঘ দিন ছিল?

নির্মলেন্দু গুণ: এটা অনেক বছর ছিল। আমি যখন পরে ঢাকাতে এলাম, এখানে এসে জুয়া খেলা আমাদের নিত্য দিনের ঘটনাই ছিল। বিদেশে গেলেও আমি খেলেছি। যে শহরে ক্যাসিনো আছে, সেখানেই চলে যেতাম। কিছুদিন আগে লাস ভেগাসে যে ম্যাসাকার হলো; ঐ যে একজন মানসিক ভারসম্যহীন একটি লোক সাতান্ন না আটান্নজন লোক মেরে ফেলল, ওইখানেও কিন্তু আমি জুয়া খেলার জন্য গিয়েছি। লাস ভেগাস হচ্ছে জুয়ার স্বর্গ। সারা পৃথিবীর জুয়াড়িরা সেখানে গিয়ে জুয়া খেলে। আটলান্টিক সিটি আছে, সেখানেও খেলেছি। আমেরিকার যে এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার প্লাজাতে আমি বেশি খেলেছি। ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট হলেন, তাকে আমি একটা চিঠি লিখেছি- অ্যা লেটার টু দ্য নিউলি ইলেকটেড প্রেসিডেন্ট! তার ওয়েবসাইটে আমি সেটা পোস্টও করেছি। আমি সেখানে লিখেছি- ‘আপনার ট্রাম্প প্লাজাতে আমি অনেকদিন জুয়া খেলেছি এবং অনেক টাকা হেরেছি; (হি ডিক্লিয়ার হিমসেলফ ব্যাংক-রাপ্ট থ্রাইস অর ফোর্থ টাইম। হি নিউ হাউ টু চিট দ্য আমেরিকান সিস্টেম) আপনি নিজেকে ব্যাংক-রাপ্ট ঘোষণা করেছিলেন; আপনার কাছে তখন অর্থ দাবি করা সমুচিত হবে না ভেবেছি, এখন তো আপনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, এখন যদি আপনি টাকাটা ফেরত না দেন, অন্তত আপনার কনভেকশনে আমাকে ডাকবেন। আপনার ক্যাসিনোতে আমি আবার খেলতে চাই। আর আপনার কাছে আমার একটাই আর্জি- আপনি আমার কথা বিবেচনা করে, বাংলাদেশের অভিবাসীদের সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করবেন না’! আমি হ্যাপি ছিলাম ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কারণে, কারণ হিলারী সম্পর্কে আমার ডিজার্ভেশন ছিল। আমার বন্ধু শেখ হাসিনাকে নানাভাবে নাজেহাল করার প্রস্তুতি তার মধ্যে ছিল এবং তিনি ইতোপূর্বেও সেটা করেছেন। ফলে আমি চাইনি হিলারী ক্লিনটন জিতুক।

প্রিয়.কম: লেখালেখির শুরুটা কখন থেকে? কীভাবে শুরু করলেন?

নির্মলেন্দু গুণ: লেখালেখির শুরুটা তো আসলে…আমি মুখে মুখে ছড়া-টড়া বানাতে পারতাম আগে থেকেই। আমাদের এলাকার পুরনো কবিদের বেশ সম্মান করতাম; কেন করতাম জানি না, অন্যদের তো করতাম না। হয়তো আমার মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল, মানুষ হয়তো তার অজ্ঞাতসারেই নিয়তি দ্বারা পরিচালিত হয়। আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাসী ছিলাম, ভাগ্যে ছিলাম অনাস্থাশীল। এখন যেমন দেখতে পাচ্ছি, ভবিতব্যে জীবনের মিল। ভবিতব্য বলে একটা জিনিস থাকতে পারে, নাহলে রবীন্দ্রনাথরা ভাই-বোন মিলে তের-চৌদ্দজন ছিলেন। তার অন্য ভাই-বোনরা তো কেউ কবি হননি। একই পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছেন, একই পরিবেশে ঠাকুর বাড়ির আঙিনার মধ্যে বড় হয়েছেন- সেখান থেকেও তো রবীন্দ্রনাথ একজনই হয়েছেন। শামসুর রাহমান বলেছেন যে তিনি কবিতা লিখেছেন তার বোন মারা যাওয়ার পর। বোনের অকাল মৃত্যু তাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল বলে তিনি একটা কবিতা লিখেছিলেন। এরপর থেকে তার মধ্যে ওই উপলব্ধি আসে যে তিনি কবিতা লিখতে পারেন। এখন আমি কবিতা কেন লিখেছি, এটা স্পষ্ট করে বলতে পারব না। কেউ যুক্তিসঙ্গত-ভাবে এটা ব্যাখ্যা করতে পারবে না। আমার পক্ষেও বলা কঠিন। তবে আমার নিজ এলাকার আঞ্চলিক কবি এবং লোকসাহিত্যের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহ অনেক আগে থেকেই ছিল। ঐ এলাকায় কোনো কবি আছে কি-না, সেটা জানার, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার এবং তথ্য সংগ্রহ করার প্রতি আমি আগ্রহী ছিলাম। তাদের জানার পরে অনেকটা প্রভাবিত হয়েই এ জগতের দিকে কিছুটা ধাবিত হয়েছিলাম।

প্রিয়.কম: আপনার প্রথম বই ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ ছাপানোর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

নির্মলেন্দু গুণ: আমার প্রথম কবিতা ১৯৬১ সালে ‘উত্তর আকাশ’ নামের একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। এ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন খালেক দাদ চৌধুরী। এ পত্রিকায় একটি সাহিত্য বিভাগ ছিল, নেত্রকোণার প্রবীণ এবং তরুণ কবি-সাহিত্যকরাই সেখানে বেশি লিখতেন। এরপর মাঝখানে অনেকদিন গ্যাপ দেওয়ার পর ১৯৬৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির উপর লেখা একটা কবিতা ঢাকার ‘সাপ্তাহিক জনতা’ বলে একটা পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগ, ইঞ্জিনিয়ারিং, বি.এস.সিতে ভর্তি হওয়ার চক্করে লেখালেখিতে ভাটা পড়ে। এক দিক থেকে অবশ্য ভালোই হলো; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি যে হোঁচট খেলাম, সেটা আমাকে বাউন্স ব্যাক করতে সুবিধা করল- আই গো অ্যান্ড ব্যাক টু মাই ওউন ওয়ার্ল্ড। আমার নিজস্ব জগৎ যে কাব্য, সেটার দিকে আমার নিয়তি আমাকে ঠেলে দিলো। তখন আমি আবার কবিতা লেখা শুরু করলাম। প্রথমে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনৈতিক কবিতা; তারপর আস্তে আস্তে প্রেম বোধ জাগ্রত হলো, তখন প্রেমের কবিতা…এভাবে আস্তে আস্তে কবিতার প্রতি ঝুঁকে পড়লাম। কবিতার বইটা প্রকাশিত হয়েছে অনেক পরে, ১৯৭০ সালে। তবে তার আগেই ৬৭’ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’, ‘পয়গাম’, ‘পূর্বদেশ’- সব কাগজেই লিখতে শুরু করেছিলাম। তরুণ কবি হিসেবে মোটামুটি খ্যাতি বই প্রকাশের আগেই পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বই প্রকাশের ব্যাপারে প্রথমে কোনো প্রকাশকই আগ্রহ দেখাননি। বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছে গিয়েছি, তারা একজন নতুন কবির ব্যাপারে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। শামসুর রাহমানের বই তার এক বন্ধু নিজের টাকায় প্রকাশ করে দিয়েছিলেন; আল মাহমুদের বই তার বন্ধুরা মিলে একটা প্রকাশনা সংস্থা দিয়েছিলেন, সেখান থেকে বের করেছিলেন, আব্দুল মান্নান সৈয়দও নিজের টাকাতেই বই বের করেছেন। আমি-ই কিন্তু প্রথম যে প্রফেশনাল প্রকাশক দিয়ে বই প্রকাশ করিয়েছি। খান ব্রাদার্স থেকে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে আমার প্রথম বই ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে তো স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধই শুরু হয়, ফলে এ বইটি খুব বেশি দিন বাজারে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে চিত্তরঞ্জন সাহা বইটি আবার প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মুক্তধারা সাহিত্য সংগঠন করতেন, সেখান থেকেই বইটি বের হয়েছিল।

প্রিয়.কম: আমি শুনেছি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ বইটির প্রথম কপিটি আপনি একজন গণিকাকে দিয়েছিলেন... 

নির্মলেন্দু গুণ: এটা তুমি কোথায় শুনলে? বই এর মধ্যে লিখেছি নাকি?

প্রিয়.কম: আমি কোথায় যেন এক জায়গায় পড়েছিলাম ঘটনাটা...

নির্মলেন্দু গুণ: বইটার যে প্রচ্ছদটা ছাপা হয়েছিল বাবু বাজারের খুশি প্রিন্টার্স বলে একটা জায়গা থেকে। প্রথম বই বেরোচ্ছে খুব আবেগে এবং ফূর্তিতে ছিলাম। বইটা যেখানে ছাপা হয়েছে তার পাশেই একটা গণিকা পল্লী ছিল। সেখানে আমাদের কয়েকজন বন্ধুর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। প্রথম বই ছাপানোর উত্তেজনাটা কারো সাথে শেয়ার করার ইচ্ছা হয়েছিল আমার, এই আবেগটাকে শেয়ার করার জন্য কাউকে পাইনি তখন। সেই সূত্রেই আমার সঙ্গে যার ভালো সম্পর্ক ছিল, ওই মহিলাকে বইয়ের কাভারটা দিয়েছিলাম। সে জিজ্ঞেস করলো ‘এটা কী’? সে তো এ বিষয়ে কিছু জানে না। আমি বললাম এটা তোমার ঘরের মধ্যে টাঙানো থাক, তুমি যে আমার খুব প্রিয়- এটা তারই প্রমাণ বহন করবে। আমি নিজেই ওইটা তার ঘরে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম।

প্রিয়.কম: পঁচাত্তর পরবর্তী সময় আপনাকে তো গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে শুনেছি...

নির্মলেন্দু গুণ: সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ৭ই নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানে যখন খালেদ মোশাররফসহ অনেকেই নিহত হয়েছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। তারা সেটাকে সিপাহী বিপ্লব বলে দাবি করেছিলেন, কিন্তু তাদের চরিত্র- কোনো বিপ্লবী চরিত্র ছিল না। খালেদ মোশাররফকে হত্যা করার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা তার বাড়ি লুট করেছিল। শুধুমাত্র একটি ভাঙা চেয়ার রেখে সবই তারা লুট করে নিয়ে যায়। সুতরাং যারা ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের কথা বলে, তাদের চরিত্রে যদি বিন্দুমাত্র বিপ্লবের উপাদান থাকতো তাহলে খালেদ মোশাররফের বাড়ি এভাবে লুণ্ঠিত হতো না। তার সঙ্গে আরো যারা নিহত হয়েছিলেন বজলুল হুদা এবং এটিএম হায়দার- তাদের তিনজনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল। সে সময় যখন সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হচ্ছিল, বিটিভি তখন রামপুরাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। সেখানে গিয়ে আকমল, মুনীরুল আলম- এ রকম কয়েকজনকে ওরা ভারতীয় চর অভিযোগে হত্যা করে। সেনাবাহিনীর উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনো চেইন অব কমান্ড নেই-  এ রকম একটা অবস্থায় আমার বন্ধু আবুল হাসান তখন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাকে দেখতে গিয়ে আমি অপেক্ষমান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তারা সেখানে কার জন্য, কেন অপেক্ষা করছিল- এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে- আমাকে ধরেই যখন তাদের অপেক্ষার শেষ হলো, তখন আমার জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছিল। একজন কর্নেল আমাকে অ্যারেস্ট করে একটা ট্রাকে উঠতে বললেন, যেহেতু সেনাবাহিনীর মধ্যে তখন কোনো কমান্ড নেই, ফলে আমি ঐ ট্রাকে উঠতে ভয় পাচ্ছিলাম। ট্রাকের মধ্যে অধিকাংশই অশিক্ষিত জোয়ানরা আছে, আমি কবি হিসেবে কতটা মূল্য বহন করি- তারা তো সেটা বুঝবে না। আমার সঙ্গে হয়তো মিসবিহেভ করবে, কিংবা মেরেও ফেলতে পারে। যে কর্নেল আমাকে গ্রেফতার করল, তাকে আমি গিয়ে বললাম- স্যার, আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হলেন না, ফলে জোয়ানদের রোষের মধ্যে আমাকে পড়তে হলো। তারা ভাবলো আমি তাদের প্রতি আস্থা রাখিনি, তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হইনি। তখন আমার দিকে অস্ত্র তাক করে তারা ভয় দেখানো শুরু করল। এরপর আমাকে সোহরাওয়ার্দীর ভেতরে পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। এখন যেটা থানা হয়েছে, আগে সেটা পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। যখন আমি ঐ ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকছি, কর্নেল সাহেব তখন বের হয়ে যাচ্ছেন। আমি সেল্যুট দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম, তিনি না তাকিয়েই চলে গেলেন। ভেতর থেকে একজন পুলিশ অফিসার এসে আমাকে রিসিভ করে নিয়ে গেলেন। ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ অফিসারটি আমার কানে কানে বলল- আপনি ভয় পাবেন না, যে অফিসার আপনাকে অ্যারেস্ট করেছেন, তিনি আমাদের লিখিত দিয়ে গেছেন- ‘ডোন্ট মিসবিহেভ উইথ হিম’। ঐ কর্নেল ভদ্রলোকের নাম ছিল কর্নেল নওয়াজেশ আহমেদ। এরপরে ঐ ক্যাম্প থেকে রমনা থানার পুলিশকে ডাকা হলো, যাতে তাদের কাস্টডিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রমনা থানায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, ওইখানে আমি সাত দিন ছিলাম। 

প্রিয়.কম: রমনা থানায় আপনি যখন ছিলেন, আপনাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বোধহয় বিবৃতি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন কবি মহাদেব সাহা। তখন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান এবং আহসান হাবীব নাকি আপনার পক্ষে কাজ করার জন্য তাকে ডিসকারেজ করেন?

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ। মহাদেব অ্যাটেম্প নিয়েছিল আমাকে মুক্তির জন্য একটা বিবৃতি প্রকাশ করতে। কিন্তু তুমি যাদের নাম বললে, তারা নিজেরা তো বিবৃতি দিতে রাজি ছিলেনই না, মহাদেবকেও ডিসকারেজ করেছিলেন এটা বলে যে- ‘তোমার এটা নিয়ে মুভ করা উচিত না, কারণ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর নির্মল কোথায় ছিল সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই’। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমি গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিলো- যে কোনো সময় আমাকে মেরে ফেলা হবে। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। দীর্ঘ সময় আমাকে অনুপস্থিত দেখে, তারা অনুমান করতে পারেননি হোয়াট আই ডিড দ্যাট টাইম। আমি তো অ্যারেস্ট হয়েছি ১১ নভেম্বর, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে ১৫ আগস্ট। ১৮ আগস্ট আমি ঢাকা ত্যাগ করেছি অ্যান্ড কেম ব্যাক টু ঢাকা অন ফাস্ট নভেম্বর। ফলে এই আড়াই মাস সময় যে আমি বাড়িতে ছিলাম, এ সময় কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ভারতে একটা বাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। সেখানে অনেকেই যোগদান করেছিল এবং মজার বিষয় হচ্ছে ওই বাহিনীতে ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলের মানুষই বেশি ছিল। তো তারা মাঝে মাঝে আক্রমণ করতো। আমার যেহেতু বাড়ি ঐদিকেই, ফলে অনেকের ধারণা হয়েছিল সম্ভবত আমি কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, আর ভারতের সঙ্গেও বোধহয় আমার একটা যোগাযোগ আছে। 

প্রিয়.কম: ব্যক্তি লেখক এবং তার লেখক সত্ত্বা কী অভিন্ন নাকি আলাদা?

নির্মলেন্দু গুণ: আলাদা কি করে হয়- এটা আমি বুঝি না। যিনি লেখক তিনি তো তার দেহের বাইরের সত্ত্বা নন। তিনি দেহের ভেতরেই বাস করেন। সুতরাং এই দেহের সঙ্গে তার তো কোনো বিরোধ নেই। তবে আমি যেরকম অকপটে জীবনের সকল সত্য প্রকাশ করি, তাতে আমাকে অন্যের কাছ থেকে ভিন্ন মনে হতে পারে। এটা হয়তো বলতে পারো- আপনার জীবনের সঙ্গে অন্যের জীবনের মিল নেই। যেমন একজন বলেছিল- আপনি যেভাবে আপনার বোহেমিয়ান জীবনের কথা বর্ণনা করেন, তাতে আমাদের পক্ষে আপনার রচনা পাঠ করার কথা ছেলে-মেয়েদের বলা সম্ভব হয় না। আমি বললাম- আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করছি; সে অভিজ্ঞতা মানুষকে তার ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী করবে, এ অভিজ্ঞতা মানুষকে আপোষহীন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করা শেখাবে। ঢাকা শহরে থাকার মতো কোনো ব্যবস্থা আমার ছিল না। ১৯৬৬ সালে একটা পত্রিকায় আড়াইশ টাকা বেতনের চাকরি পাই। প্রথম বেতন পেয়ে আমি একটা বালিশ কিনেছিলাম যে নিজের বালিশে ঘুমাতে পারব, একটা থালা কিনেছিলাম এটা ভেবে যে নিজের থালায় খাব। নিজের থালা-বালিশ কেনা আমার সঙ্গতির মধ্যে ছিল না; চিন্তার মধ্যেও ছিল না, এগুলো যে আমার নেই- সেই উপলব্ধিও আমার ছিল না। ‘আমার কণ্ঠস্বর’ বইটি পড়লে আমার জীবন সংগ্রামের সঙ্গে পাঠকের যে পরিচয় হবে- সেটা তাদেরকে জীবনে সংগ্রাম করতে সহায়তা করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসীতে ভর্তি হতে পারলাম না; মেডিকেলে পড়তে পারলাম না, কিন্তু আমার জীবনে যে বড় হওয়ার স্বপ্ন- সেটা মরে যায়নি। প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে; বর্ষা-প্লাবনের মধ্যে পাল্লা দিয়ে যে ধানগুলো বাড়ে- আমি সেভাবে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করেছি। সে কারণে আমার অকপট স্বীকারোক্তিগুলো মনে হয় সবার জানা জরুরি, জরুরি না হলেও আমি কী রকম সেটা তো আমাকে বলতেই হবে। আমি মিথ্যে কথা বলে মানুষের চিত্ত জয় করতে চাই না।

প্রিয়.কম: আপনার অসংখ্য প্রেমের কবিতা আছে। আপনার লেখালেখি জীবনে নারী এবং প্রেমকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

নির্মলেন্দু গুণ: এটা তো একটা প্রাকৃতিক সত্য। যে আমাদের সৃজন করেছেন অর্থাৎ স্রষ্টা যিনি, তিনি নারী এবং পুরুষদের পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য কিছু মন্ত্র তাদের ভেতরে দিয়ে দিয়েছেন। আমার ‘নিশিকাব্য’র ভূমিকায় আছে, এটা হাদিস থেকে উদ্ধৃত করছেন একজন তিউনিশিয়ান কবি। তিনি বলেছেন- ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি এই পুরুষের প্রিয় অঙ্গসমূহ নারীর দেহে এবং নারীর প্রিয় অঙ্গসমূহ পুরুষের দেহে সংস্থাপন করেছেন’। এখন তিনি একটা নারী মূর্তি তৈরি করলেন আর একটা পুরুষ মূর্তি তৈরি করলেন- তারা যদি পরস্পর আকৃষ্ট বোধ না করে, ইফ দে ডু নট এপ্রিশিয়েট ইচ আদার- তাহলে তো তারা ইউনাইটেড হওয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না। আর যদি ইউনাইটেড হওয়ার প্রয়োজন বোধ না করে, তাহলে তো সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যে সে অংশগ্রহণ করবে না। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না-  তুমি তাই এসেছ নীচে/আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর/তোমার প্রেম হত যে মিছে/ আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা/আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা/মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে/তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে’। অর্থাৎ এখানে স্রষ্টার ইচ্ছাটা তরঙ্গিত হচ্ছে নারী এবং পুরুষের মাধ্যমে। যার ফলে নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ থাকে। এটা শুধু মানুষের ক্ষেত্রে না, রিপ্রোডাকশন বা নিজেকে পুনরায় সৃষ্টি করার একটা আগ্রহের দিক থেকে পৃথিবীর সকল জীব-জন্তুর মধ্যেই ঐক্য আছে। সুতরাং নারীর প্রতি যে পুরুষের আকর্ষণ বা পুরুষের প্রতি যে নারীর আগ্রহ- এটা প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের মধ্যে স্রষ্টা দিয়ে দিয়েছেন। আমরা শুধু তার ডাকে সাড়া দিচ্ছি। আমাদের ভেতরের যে প্রবণতাগুলো শৈশবে সুপ্ত আকারে থাকে, সে সময় তো আমরা নারী-পুরুষের ব্যবধানটা বুঝতে পারি না, মানে পার্থক্যগুলো তো ছোটবেলায় ধারণাতে আসে না। আচার-আচরণের মধ্যেও কোনো পার্থক্য বোঝা যায় না। কিন্তু বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাচ্ছে যে নারীর প্রতি পুরুষের বা পুরুষের প্রতি নারীর এক ধরণের কাম তৃষ্ণা জাগ্রত হচ্ছে। ফলে এটারই একটা সভ্য-সংস্কৃত প্রকাশ হচ্ছে ‘প্রেম’। এই প্রেমটা কোনো মৌলিক রিপু নয়, মৌলিক রিপু হচ্ছে ‘কাম’। মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো, নিজেদের পরিবর্তন করার শক্তি আমাদের আছে। আমাদের ভেতরে যে প্রকৃতি প্রদত্ত হয়েছে, সে প্রকৃতি পরিবর্তন করার ক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। ফলে আমরা ধর্ষণকে উৎসাহিত করি না, প্রেমকে উৎসাহিত করি। ধর্ষণ সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্য করা হয়, এটা অন্যায় এবং পাপ। মানব জাতির গর্ভধারিণী হচ্ছে নারী, সেই নারীকে পূজনীয় জ্ঞান করা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধে নত হওয়া যেখানে পুরুষের কর্তব্য, সেখানে শিকড় অস্তিত্বের এই নিগুঢ় সত্যটিকে উপলব্ধি করতে না পেরে ধর্ষক তার কামকে চরিতার্থ করার জন্য নারীর উপর অত্যাচার করছে। সঙ্গম আর ধর্ষণের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, এটা ঐ ধর্ষকরা ভুলে যাচ্ছে। এখানে সে অন্য বন্য প্রাণীর থেকেও ভয়ঙ্কর আচরণ করছে। ফলে তাকে পাশবিক যখন বলা হয়, তখন মূলত পশুকে অপমান করা হয়। পশুর মধ্যে এই পাশবিকতা নেই, যে অন্যায়, নিষ্ঠুর আচরণ আমরা মানুষের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। কদিন আগে আমি লিখেছি- মায়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই। সেটা আমি লিখেছি- রোহিঙ্গা নারীদের উপর অত্যাচারের ভিডিওগুলো দেখে। যে নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, তাকেই আবার মেরে ফেলা হচ্ছে। মানুষের চরিত্রের এই অধঃপতন, অমানবিকতাকে পরাভূত না করা পর্যন্ত মানুষ যে সভ্য- এটা দাবি করা যাবে না।

প্রিয়.কম: সব সৃষ্টিই তো স্রষ্টার কাছে খুব প্রিয় বা সন্তানতুল্য। আমরা আপনার কণ্ঠে আপনার সৃষ্ট একটি প্রিয় কবিতা শুনতে চাই...

নির্মলেন্দু গুণ: এই কবিতাটা (‘তোমার চোখ এত লাল কেন’) আমারও খুব প্রিয়, পাঠকদেরও প্রিয়। এটা আবার গ্রামীণফোনেরও খুব প্রিয়। গ্রামীণফোন এটাকে ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে মাসে ত্রিশ টাকা করে কেটে নিচ্ছে, কিন্তু আমাকে তারা আজ পর্যন্ত একটি পয়সাও রয়্যালিটি দেয়নি। সে জন্য আমি এই কবিতাটা পাঠ করছি এবং গ্রামীণফোনের প্রতি এই অভিযোগ উত্থাপন করছি- তারা আমার এই কবিতাটি বহু বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে, কিন্তু আমি তাদের কাছে আজ পর্যন্ত কোনো টাকা পাইনি। অনেকবার আমি ফেসবুকের স্ট্যাটাসেও এটা লিখেছি। আমাদের বর্তমান যে টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী আছেন; তাকেও বলেছি। তারাও আমার এই ন্যায্য-ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায় করে দিতে পারেননি, কিংবা কোনো উদ্যোগই হয়তো গ্রহণ করেননি। আমি এর প্রতিবাদ জানিয়ে কবিতাটি পাঠ করছি…

“আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,

শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য।

বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ আমাকে খেতে দিক।আমি হাতপাখা নিয়ে

কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,

আমি জানি, এই ইলেক্ট্রিকের যুগ

নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।

আমি চাই কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করুক:

আমার জল লাগবে কিনা, নুন লাগবে কিনা।

পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা

তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না।

এঁটো বাসন গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা খুলে দিক।

কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।

কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে

জিজ্ঞেস করুক, ‘তোমার চোখ এত লাল কেন’"?

প্রিয়.কম: একজন কবি বা লেখককে কতটা রাজনৈতিক সচেতন হতে হয়?

নির্মলেন্দু গুণ: এটা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। আমরা যে ভূখণ্ডে বাস করছি, সেটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু খুব অল্প কথায় ইতিহাসটা বর্ণনা করেছিলেন- ‘৫২’ সালে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, ৫৪’ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও ক্ষমতার গদিতে বসতে পারি নাই, ৫৮’ সালে আইয়ূব খান সামরিক শাসন জারি করে আমাদের দশ বছরের জন্য গোলাম করে রেখেছেন, কী অন্যায় করেছিলাম?’- এই যে তিন-চারটা ঘটনা উল্লেখ করে তিনি দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন...অল্প কথায় বলতে গেলে আমরা যদি বৃটিশ আমল থেকে ধরি, আমরা দুশ বছর বৃটিশদের গোলামী করেছি, তারপরে পাকিস্তান হলো, ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। ভাষার জন্য গান লেখা, রক্ত দেওয়া। ৫৪’ সালে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করল, তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হলো না। ৫৮’ সালে সামরিক শাসন চলে আসলো, যেটা আমরা ১৯৬৯-৭০ পর্যন্ত পেলাম। প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষকে যত সংগ্রাম করতে হয়েছে, এ রকম সংগ্রাম খুব কম জাতি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করার মতো একটি জাতিই আছে, তারা হলো ভিয়েতনামের জনগণ। তারাও অনেক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। আমাদেরও অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন হলো, কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। অপশক্তি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অঙ্গিকার থেকে দেশকে সরিয়ে আবার পাকিস্তানি ভাব ধারায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। এই সর্ব সময়টা আমাকে তো বিভিন্ন অপশক্তির বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হয়েছে, আমি তো সব সময় প্রেমের কবিতা লিখতে পারিনি। ‘তোমার চোখ এত লাল কেন’?- এ প্রশ্ন যেই প্রেমিকার কাছে আমি প্রত্যাশা করছি, তাকে তো আমি সময় দিতে পারিনি। আমাকে তো বারবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের কবিতার এই বৈশিষ্ট্য অন্যসব কবিতা থেকে বাংলাদেশের কবিতাকে আলাদা করেছে। এ দেশের কবিতা- সংগ্রামী কবিতা, সংগ্রামের কবিতা।

প্রিয়.কম: আপনার একটা কবিতার কিছু লাইন আছে, ‘আর কিছু তো আরাধ্য নয়, কাব্য এবং নারী ছাড়া/ ওটা পেলে জাহান্নামেও যেতে আমি এক পা খাড়া’।

নির্মলেন্দু গুণ: হুম। ‘গুণ তো আমার নামেই আছে জন্মসূত্রে ছায়ার মতন/দোষটা আমার কর্মসূত্রে খেটে-পাওয়া, অর্জিত ধন...’

প্রিয়.কম: আপনার এটা খুব জনপ্রিয় কবিতা। আপনার অসংখ্য ভক্ত আছে এ কবিতার। কিন্তু এ কবিতার যারা ভক্ত- স্বাধীনতা পদক পাওয়ার জন্য যে স্ট্যাটাসটি আপনি দিয়েছিলেন, সেটা বোধহয় তাদের জন্য বেশ দুঃখজনক ছিল। আপনার কাছে তো নিশ্চয়ই এর ব্যাখ্যা আছে...

নির্মলেন্দু গুণ: অনেক মানুষ একসঙ্গে ভুল করতে পারে, কিংবা অনেক মানুষ একসঙ্গে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্কটল্যান্ড একবার ইংল্যান্ড থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পরবর্তীকালে দেশের মানুষ আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করেছে। আমি বলছি যে অনেকগুলো মানুষও কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমন আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে। আমি দেখেছি যে ঐ ঘটনার বিপুল প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ আমার এভাবে পুরস্কার চাওয়াটা গ্রহণ করতে পারেননি। কবির সম্পর্কে যে ধারণা তাদের মনের মধ্যে আছে, সেটা তো আমি না। তারা তো আমার মতো কবি দেখেননি। আমার মতো কবি কীভাবে রিয়্যাক্ট করে, কীভাবে চায়- আমার চাওয়ার পদ্ধতির সঙ্গে তারা পরিচিত না। আমার অনেক কিছুই তারা নিতে পারবে না। এই যে তুমি একটু আগে বললে যে- আপনার প্রথম বইটা আপনি একজন গণিকাকে দিয়েছিলেন, এটা পৃথিবীর খুব কম কবি-ই স্বীকার করবেন। আমার কন্যা একবার আমাকে প্রশ্ন করেছে- বাবা তুমি কী গণিকালয়ে যেতে? আমি বলেছি হ্যাঁ, যেতাম। আমার মেয়ে আমাকে বলেছে- থ্যাংক ইউ, তুমি সত্য কথা বলেছো তাই। আমার মতো কবি তারা দেখেনি বলে আমার আচরণে কষ্ট পেয়েছে। আমার মতো আর কেউ চাইতে পারবে? স্বাধীনতা পুরস্কার চাওয়ার মতো শক্তি কি তাদের আছে, সাহস আছে তাদের? যাদের নেই, তারা ভাবছে- এই কি! এই কবি পুরস্কার চায় কেন! আবার প্রধানমন্ত্রী সে দাবি মেনেও নেন! প্রধানমন্ত্রীর ক্যাবিনেটের মিনিস্টাররা পর্যন্ত বিব্রত হয়েছেন। তারা আমাকে মনোনীত করেননি বলে শেখ হাসিনা তাদেরকে ভৎসনা করেছেন। কেন এত দিন আমার নাম তারা মনোনয়ন দেননি। তিনি বলেছেন- নির্মলেন্দু গুণ যদি স্বাধীনতা পুরস্কার না পায়, কারা পাচ্ছে তবে এ পুরস্কার? আই ডিজার্ভ ইট সো প্রাউডলি, সো স্ট্রংলি- ফলে আমার কাছে এটা না পাওয়াটাই অসম্মানজনক ছিল। পাওয়াটা যে সম্মানজনক হয়েছে তা নয়, কিন্তু না পাওয়াটা খুব অসম্মানজনক ছিল। সে জন্য আমি এই বিরক্তিকর জিনিসটির অবসান হোক চেয়েছি। আমি ভেবেছি, আমি যদি চাই- তবে তাদের পুরস্কারের মূল্যটা বৃদ্ধি পাবে। আমি চাইলে এ পুরস্কার যে খুব কাঙ্ক্ষিত এবং প্রত্যাশিত- এটা লোকে জানবে। তো পুরস্কারের মূল্য বৃদ্ধি হলে আমার তো কোনো ক্ষতি নাই। পরবর্তীতে যারা পাবে, তারা একটা উর্ধ্ব মূল্যের পুরস্কার পাবে, যে পুরস্কার নির্মলেন্দু গুণ প্রকাশ্যে চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে না চেয়ে আমি যদি গোপনে শেখ হাসিনার কাছে পুরস্কার চাইতাম, সেটা কি ভালো হতো? অনেকে তো গোপনে চাইছে! আমি যে গোপনীয়তায় বিশ্বাস করি না- তারা সেটা বিবেচনা করেনি, তারা ভেবেছে- আমার এভাবে চাওয়াটা ঠিক হয়নি। এটা না চাইলে এখনো আমার ভেতরে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কাজ করতো হয়তো। যে আমি স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো সেই কবিতা লিখিছি, যে আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছি, যে আমি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কবিতা লিখলাম- আমি ছাড়া এ পুরস্কার দাবি করার দ্বিতীয় ব্যক্তি আমি দেখি না। আমাকে যারা ছোট দেখতে চায়, বঞ্চিত দেখতে চায়, তারাই আমাকে পুরস্কারবিহীনও দেখতে চায়। আমি চেয়েছি তাই আমাকে দিয়েছে। এখন আরেকজন চেয়ে নিক, আমি তো পথ সহজ করে দিলাম। তারা এখন প্রমাণ করুক- চাইলেই দেয় কি-না!

প্রিয়.কম: আপনার অনেক ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু ছিলেন আমাদের আরেকজন জনপ্রিয় কবি আবুল হাসান। তার সঙ্গে আপনার স্মৃতিগুলো যদি শোনাতেন...

নির্মলেন্দু গুণ: ‘আমার কণ্ঠস্বর’ বইটিতে আমাদের যৌথ জীবন নিয়ে আমি লিখেছি। আমরা দীর্ঘ দিন একসঙ্গে থেকেছি। সেও কিন্তু কবিতার জন্য আমার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছিল। আমরা একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলাম। লেখাপড়া করে ডিগ্রী অর্জন করে, চাকরি করে, সরকারি আমলা হয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে আমরা আমাদের প্রতিভার অপচয় করতে চাইনি। আবুল হাসান সম্পর্কে আমার আপত্তির একটা জায়গা আছে- যখন ২৫ মার্চের জেনোসাইড ঢাকাতে হলো, তারপরে এ শহরকে যারা বাসযোগ্য বলে মনে করেছিল- হি ওয়াজ এমং দেম। অথচ তার বয়স ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।

প্রিয়.কম: আমাদের অনেক কবি-ই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি বা করতে পারেননি...

নির্মলেন্দু গুণ: যারা করেননি, যাদের বয়স ছিল, যারা বলে- ‘এখন যৌবন যার/যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিল? শ্রেষ্ঠ সময়টা তারা কোথায় কাটিয়েছিল? জাতি তো জানতে চায় সেটা, তাই না? সুতরাং তাদের সাথে বন্ধুত্ব ছিল, বন্ধুত্ব এখনো আছে কিন্তু এই ক্ষোভটাও আছে। যেমন শামসুর রাহমান যুদ্ধে যাননি কিন্তু তিনি ‘তোমাকে আসতেই হবে স্বাধীনতা’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ বা ‘স্বাধীনতা তুমি’- এ কবিতাগুলো তো লিখেছেন। তিনি ঢাকাতে বন্দী শিবিরে থেকেও ছদ্মনামে কবিতা লিখে সেগুলো পাঠিয়েছেন ভারতে। সেগুলো কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। জাতির দুঃসময়ে যখন দেশকে বাঁচাতে মানুষ যুদ্ধ করছে, আমাদের তরুণ কবিদের মধ্যে অনেকেই এখানে থেকে গিয়েছিলেন, যুদ্ধের পক্ষ তো তারা নেয়-ইনি, শামসুর রাহমানের মতো কবিতা লিখে পাঠানোর এই প্রয়াসটাও তো তাদের মধ্যে দেখিনি তখন। কালের ইতিহাসে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন তারা। তুমি কোথায় ছিলে, কী করছিলে? কাদের সমর্থন করেছিলে- এ প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলেই অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর থাকে না।

প্রিয় সাহিত্য/গোরা