ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনি। ছবি: সংগৃহীত
‘সন্তান এতই অভাগা যে কোনোদিন পিতার মুখ দেখতে পাবে না’
আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:১৪
(প্রিয়.কম) ‘গ্রেফতার হওয়া ছোট ভাইকে দেখতে সেদিন কেন্দ্রীয় কারাগারে যান জনি। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। তার সন্তান এতটাই অভাগা যে, কোনোদিন পিতার মুখ দেখতে পাবে না’, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিন বছর আগে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ছাত্রদল নেতা নূরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভীন মণীষা।
তিন বছর আগে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ভোররাতে খিলগাঁও রেলগেট জোড়াপুকুরপাড় এলাকায় খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনি (৩০) কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। জনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
২০ জানুয়ারি শনিবার নুরুজ্জামানের স্ত্রী মুনিয়া পারভীন মণীষা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘প্রিয়জন হারানো কতটা বেদনা বিদারক তা কেবল প্রিয়জন হারালে বোঝা যায়। এই কষ্ট বলে বোঝানো যায় না। কি অপরাধ ছিল আমার স্বামীর? কেন ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করল?’ এই কথাটুকু বলেই নিশ্চুপ থাকেন তিনি।
কিছু সময় পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মণীষা বলেন, ‘আপনারই বা কি করার ক্ষমতা আছে? এই তো আজ যোগাযোগ করেছেন কিছু কথা বলছেন-শুনছেন, হয়তো সবকিছু লিখতেও পারবেন না। বলতে কষ্ট লাগে।
রাজনীতি করাই যদি অপরাধ হয়, তবে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান তিনি। কাঁদতে কাঁদতে মণীষা বলেন, ‘সে তো সন্ত্রাসী ছিল না। তবে কেন তাকে হত্যা করা হলো, রাজনীতি করাই কি তার অপরাধ? তাহলে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। আমার স্বামী রাজনীতি করলেও কোনো নাশকতায় জড়িত ছিলেন না। ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার কারণেই তাকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে।’
নিহত হওয়ার মাত্র দেড় বছর আগে ২০১২ সালে ২৩ নভেম্বর নুরুজ্জামান জনির সঙ্গে বিয়ে হয় মুনিয়া পারভীন মণীষার। জনি যখন নিহত হন, মুনিয়া তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিহত নূরুজ্জামান জনি দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় ছিলেন। তাদের বাসা খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায়।
শুরু থেকেই পরিবারের দাবি, নিহত জনিকে বন্দুকযুদ্ধের নামে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু তৎকালীন সময়ে পুলিশ দাবি করেছিল, নূরুজ্জামান জনি মৎস্য ভবন এলাকায় পুলিশের বাসে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন আসামি। ২০১৫ সালে ১৯ জানুয়ারি বিকালে তাকে আটকের পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল পরদিন ভোর তিনটার দিকে খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় অভিযানে গেলে দুর্বৃত্তরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে জনি আহত হয়। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তবে সুরতহাল রিপোর্টে নুরুজ্জামানের বুক, পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে মোট ১৬টি গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে উল্লেখ করে পুলিশ।
জনির নবজাতক সন্তানকে উপহার সামগ্রী পাঠান বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত
ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনির হত্যার স্মৃতিচারণ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রিয়.কমকে বলেন, ‘২০১৫ সালে আজকের এই দিনে জনিকে গ্রেফতার অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুধু জনি নয়, গত কয়েক বছরে আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে তারা (আইন শৃঙ্খলা বাহিনী) হত্যা করেছে। একটি হত্যারও বিচার হয়নি। তারা ক্ষমতায় জোর করে টিকে থাকতে শক্তি প্রয়োগ করতে বন্দুক ব্যবহার করছে, ছাত্রনেতাদের হত্যা করছে। আমরা মনে করি এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।’
তিনি বলেন, ‘নুরুজ্জামান জনি এতটাই দুর্ভাগ্য যে তার হত্যার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা একটি জিডি পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। একটাই দোষ সে বিএনপি করে।’
নুরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের এক সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ওই সময় নুরুজ্জামান জনিকে গ্রেফতারের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ গোড়ান এলাকায় তার বাবা ইয়াকুব আলীর সিএনজি গ্যারেজে অভিযান চালায়। কিন্তু ওই সময় জনি গ্যারেজে না থাকায় তার ছোট ভাই মনিরুজ্জামান হীরাকে ধরে নিয়ে যায়। ছোট ভাই হীরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও পরদিন পুলিশ তাকে খিলগাঁও থানার একটি গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায়। পরদিন সোমবার দুপুরে দিকে জনি তার বন্ধু মইনসহ ৩-৪ জন তার ছোট ভাই হীরাকে দেখতে জেলখানায় যায়। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার থেকে ২-৩ জন লোক নেমে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে জনি এবং মইনকে আটক করে। পরবর্তীতে মইনকে খিলগাঁও থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলেও গোয়েন্দা পুলিশ জনিকে মিন্টো রোডের কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। তারপর ২০ জানুয়ারি ২০১৫ সালের ভোররাতে খিলগাঁও রেলগেট জোড়াপুকুরপাড় এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নুরুজ্জামান জনি।’
এদিকে ছাত্রদল দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনির পুত্র সন্তান জন্ম নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নানান উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে পরিবারের খোঁজখবর নেন। খালেদা জিয়া মাঝে মধ্যে জনির পরিবারের কাছে বার্তা পাঠিয়ে খোঁজখবর নেন এবং ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করতে বলছেন।
প্রিয় সংবাদ