কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ছবি সংগৃহীত

দ্য নিউজ মিডিয়া: হোয়াট এভরিওয়ান নিডস টু নো || যেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি সংবাদ ও সাংবাদিকতাকে বদলে দিচ্ছে

মিজানুর রহমান
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:০৩
আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:০৩

নিউ ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক সি. ডব্লিউ. অ্যান্ডারসন, অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক লিওনার্ড ডাউনি জুনিয়র এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির জার্নালিজমের অধ্যাপক মাইকেল শাডসন দ্য নিউজ মিডিয়া: হোয়াট এভরিওয়ান নিডস টু নো নামের একটি বই লিখেছেন। ২০১৬ সালে বইটি প্রকাশ করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। বইটিতে লেখকরা সাংবাদিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। সেই বই অনুসারে ধারাবাহিকভাবে অনুলিখন করছেন মিজানুর রহমান

আজকের পর্ব: যেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি সংবাদ ও সাংবাদিকতাকে বদলে দিচ্ছে

(প্রিয়.কম) আজকাল সাধারণ মানুষ হোক কিংবা কোনো সংবাদমাধ্যমের নিউজরুম হোক, কোনো খবর ও খবর সংশ্লিষ্ট ছবি-ভিডিও প্রথমে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণেই সাবার কাছে পৌঁছায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব খবর সর্বপ্রথম সামাজিক মাধ্যমে তুলে দেন সাধারণ মানুষ বা কোনো সাংবাদিক। পেশাদার সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে সামাজিক মাধ্যমেই ঘটনার আনুমানিক একটা ধারণা বা চিত্র পেয়ে যান। তারা খুব দ্রুত ইন্টারনেট ঘেঁটে সংশ্লিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষাপট, সংশ্লিষ্ট আরও ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত পেয়ে যান। তথ্য সংগঠিত করা, বিশ্লেষণ করা কিংবা প্রদর্শন করার জন্য তারা নানান আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারেন।

একটি খবর লেখার সময় সাংবাদিকেরা কিংবা সংবাদমাধ্যম ক্রমাগতভাবে ঘটনা সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন আপডেট পোস্ট করতে পারেন। খবরের মধ্যেই মানুষের প্রতিক্রিয়া, ঘটনাপ্রবাহ লিখতে পারেন। এসবের জন্য পত্রিকার পরবর্তী সংস্করণ কিংবা পরবর্তী রেডিও-টিভি অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। মাল্টিমিডিয়া বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন সাংবাদিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সাংবাদিকরা এখন খবর তৈরির পাশাপাশি নিজেরাই খবর সংশ্লিষ্ট ছবি ও ভিডিও তৈরি করেন। নতুন পাঠকদের জন্য পুরানো খবরও ওয়েবসাইটে রেখে দেওয়া যায়। কোনো ধরনের ছাপা পত্রিকা ছাড়াই এসব কিছু দেশ ও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায় শুধু ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে। বর্তমান ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরণ করা অগণিত সংবাদমাধ্যম থেকে পাঠক তার পছন্দের সংবাদটি বাছাই করতে পারেন এবং সামাজিক মাধ্যমে তার বন্ধুদের জন্য তা শেয়ারও করতে পারেন।

এছাড়া আরও নানাভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন সংবাদ ও সাংবাদিকতাকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। অধিকাংশ পরিবর্তনই লাভজনক। সাংবাদমাধ্যমগুলো এখন অতি দ্রুত বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর জন্য ঘটনার গভীরে ঢুকে বিস্তারিত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে পারে। এখন সংবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভিডিও, স্লাইড শো,অ্যানিমেশন, চার্ট, ম্যাপ এবং গ্রাফিক্স যোগ করা যাচ্ছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানের লিংকও সংযুক্ত করে দেওয়া যাচ্ছে, যাতে পাঠকরা বিষয়টিতে আরও ভিন্ন ধারণা পেতে পারে।

কিন্তু এ ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো গতানুগতিক সংবাদমাধ্যম ও তাদের প্রতিষ্ঠিত সংবাদ রীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ডিজিটাল মিডিয়ার কারণে এক সময়কার বিজ্ঞাপনভিত্তিক পত্রিকা, টিভি ও রেডিও স্টেশনগুলো থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিজ্ঞাপন থেকে আয় বিষ্ময়করভাবে কমে যাওয়ায় বহু মার্কিন মিডিয়া তাদের রীতি থেকে পিছু হটেছে এবং কর্মী ছাঁটাই ও তাদের বেতন কাটতে বাধ্য হয়েছে।

বর্তমানে খুব অল্প সংখ্যক পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল একেবারে নিজস্ব সাংবাদিক দিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক খবর সংগ্রহ করে। শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য সেবা এবং বিজ্ঞান বিষয়ের খবরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমেরিকান সোসাইটি অব নিউজপেপার এডিরস’র এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার পত্রিকাগুলোর নিউজরুমে ২০০৩ সালে পূর্ণকালীন সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল ৫৪ হাজার ২০০ জন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৬ হাজার ৭০০ জনে। প্রতিষ্ঠিত মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর এত বিশাল হারে কর্মী ছাঁটাইয়ের পরও পিউ রিসার্স জার্নালিজম প্রজেক্ট’র করা এক জরিপে দেখা গেছে, এখনও মার্কিন মিডিয়াগুলোতে যত সাংবাদিক কর্মরত আছেন (আনুমানিক ৭০ হাজার), সংবাদমাধ্যমভিত্তিক বিভিন্ন ডিজিটাল স্টার্টআপে কর্মরত সাংবাদিকের সংখ্যা তার মাত্র ৭ শতাংশ।

ডিজিটাল স্টার্টআপগুলো দিন দিন গুনোত্তর হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পত্রিকা ছাপানো, ছাপানোর পর সেগুলো হাতে হাতে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া, ট্রান্সমিশন টাওয়ার স্থাপন, এসবের জন্য নিয়োগকৃত কর্মীদের বেতনের পেছনে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে না। আধুনিক প্রযুক্তি এসব ডিজিটাল স্টার্টআপগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে ও সবরকম তথ্য-উপাত্ত সহকারে খবর পরিবেশনের সুযোগ দিচ্ছে, সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতি-নীতি। কর্পোরেট মালিকানা ও গতানুগতিক সাংবাদিতকার রীতি-নীতি ভেঙে দিয়ে অনেক স্টার্টআপ যেমন স্থানীয় খবর ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, অনেকে আবার গুরুত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক খবরাখবরের ওপর। অনেকে আবার বিশ্লেষণাত্মক ও মতামতধর্মী সাংবাদিকতার ওপর জোর দিচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, অধিকাংশ স্টার্টআপই নিজেদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অবস্থান তৈরির জন্য সংগ্রাম করছে।

প্রচলিত মিডিয়ার পুরাতন আর্থিক কাঠামো ভেঙে ডিজিটাল প্রযুক্তি নতুন ও পুরাতন, উভয় ধরনের সংবাদ মাধ্যমের জন্যই নতুন নতুন আয়ের পথ উন্মুক্ত করছে। অনেকেই এখন তাদের ডিজিটাল সংস্করণের জন্য গ্রাহকের কাছে অর্থ দাবি করছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের আকর্ষণ করার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের কাছে ‘ট্রাফিক ডাটা’ সরবরাহ করছে। অনেকে আবার এমনভাবে বিজ্ঞাপন দেয়, পাঠক তেমন একটা বুঝতেই পারে না। অনেক ওয়েবসাইটে স্থানীয় ব্যাবসার বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়। তবে ছাপা পত্রিকাগুলো যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন খুইয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত আয় সে তুলনায় খুবই সামান্য।

নতুন, পুরাতন সব সংবাদমাধ্যমই এখন তাদের পাঠকদের রুচি ও অভ্যাস বুঝতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। নির্দিষ্ট কোনো সংবাদ, ছবি কিংবা ভিডিও কারা কারা পড়ছে, তাও পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক প্রতিষ্ঠান পাঠকদের মতামত ও ‘রিড’ এর ওপর ভিত্তি করে তাদের সাংবাদিকদের কাজের মূল্যায়নও করে থাকে এবং সে তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে জরিমানা পর্যন্ত করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার সংবাদ নির্বাচন করে সংবাদ মূল্যের ভিত্তিতে নয়, বরং তাদের ওয়েবসাইটের পাঠকদের রুচির ওপর ভিত্তি করে।

গুরুত্বপূর্ণ কিংবা ব্রেকিং নিউজ তাৎক্ষণিকভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। নিউজরুমে সাংবাদিকদের কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে এটি। কোনো খবরের সম্পাদকের ছাড়পত্র, সত্যতা যাচাই করে দ্রুততম সময়ে সবার আগে দিতে পারলে তা বড় সংখ্যক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্রেকিং নিউজ দিতে গিয়ে অনেক সময় ছোটখাটো ভুল থেকে শুরু করে মারাত্মক ভুলও হতে পারে এবং হচ্ছেও। যেমন- ২০১২ সালের বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলার সময় প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন মিডিয়া ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে বেশ কিছু ভুল তরুণের ছবি প্রকাশ করেছিল। একই বছরের আরও পরের দিকে কানেকটিকাটে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢুকে ২০টি শিশু ও ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে গুলি করে হত্যার পেছনে রায়ান ল্যানজা নামের এক ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করেছিল বিভিন্ন ক্যাবল টিভি চ্যানেল ও অনেক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী। কিন্তু পরে জানা গেল, তিনি নিষ্পাপ এবং ঘটনার সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং হত্যাকারী ছিলেন তার ভাই, যে নিজেও ঘটনা ঘটিয়ে আত্নহত্যা করেছিল। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ পুরোটা না পড়েই যে সাংবাদিক প্রথম টিভিতে খবরটি বলছিলেন, তাতে তিনি আদালতের রায়টির পুরো উল্টো বর্ণনা দিয়েছেন। টিভিতে প্রচারিত খবরে ওই সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, ‘আদালত অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট (ওবামা কেয়ার নামে পরিচিত) বাতিল ঘোষণা করেছে’। পরে সিএনএন ও ফক্স নিউজের সাংবাদিকরা জটিল সেই রায়ের পুরোটা পড়ে সঠিক সংবাদটি পরিবেশন করেছিলেন।

ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে এখন যে কোনো গুজব খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। মূল সংবাদটি আসার আগেই অর্ধসত্য এবং পরিকল্পিত মিথ্য সংবাদ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে যায়। সেটিকে ভিত্তি করে আলোচনা সমালোচনাও মুহূর্তেই তুঙ্গে উঠে যায়। যেমন ওবামার জন্মস্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় ইন্টারনেটে এত গুজব ছড়িয়েছে যে, ১০ শতাংশ বা তার কিছু বেশি মানুষ এখনও মনে করে, ওবামা আসলে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেননি।

অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি সাংবাদিক ও পাঠকদের ভুল তথ্য বা ছবি-ভিডিও সংশোধনের উপায়ও সহজ করে দিয়েছে। এটি যে কাউকে যথাযথ সোর্সকে উদ্ধৃত করে খবর প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিয়েছে। প্রযুক্তির কারণে এখন সাংবাদিকদের ভাবতে হচ্ছে তাদের সাংবাদিকতার ধরন কী হবে এবং পাঠকরাও সাংবাদিকদের সাংবাদিকতার কাঠামো নির্ধারণ করার সুযোগ দিচ্ছে। যে প্রযুক্তি আমেরিকার গতানুগতিক সাংবাদিকতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, ঠিক একই প্রযুক্তি আবার নতুন কাঠামোয় সাংবাদিকতাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে।