অনলাইনে ঢুঁ মারলেই দেখা মেলে এ রকম অনেক জুয়া খেলার প্লাটফর্মের
ক্রিকেটে কাঁপে মাঠ, জুয়ায় মাতে রাজধানী
আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:২২
(প্রিয়.কম) শুক্রবার দুপুরে চলছিল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) খেলা। সিলেট সিক্সার্স আর রাজশাহী কিংসের ম্যাচ। এমন সময়ে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছের একটি গলির দোকানের সামনে ভিড়। অনেক মানুষের মধ্যে সেখানে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্তরাই বেশি। আছেন রিকশাচালকরাও। সেসব মানুষের উত্তেজনা দেখে মনে হতে পারে ক্রিকেট মানুষের রক্তে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর ভাঙল সেই ভুল।
দেখা গেল তিন রিকশাচালক পরস্পরের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। এক ওভারের খেলা শেষে পরবর্তী ওভার শুরুর আগে একজন বলে উঠলেন, এই ওভারে ১২ রানের বেশি হবে ৫০ টাকা। অপর দুইজন হবে না বলে ৫০ টাকা করে বের করে অন্য আরেকজনের হাতে রাখলেন। ওভার শেষ হতে দেখা গেল রান উঠেছে ১৩। অর্থাৎ ৫ মিনিটেই ১০০ টাকা ‘জিতে নিলেন’ প্রথম রিকশাচালক।
এই চিত্র শুধু ওই দোকানের নয়। আশেপাশের অন্য অনেক দোকানেও একই রকম ভিড়। রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও ক্রিকেট ঘিরে এই ধরনের জুয়া খেলা চলছে। যাদের বেশিরভাগই শুরুতে ভয়াবহতার বোঝে ওঠার আগেই সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেন।
রাজধানীর আমিন বাজারে চলে নিয়মিত জুয়ার আসর। এখানেও অংশ নেন নিম্নমধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা। টাকা ছাড়াও সেখানে জুয়া ধরতে ব্যবহৃত হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিপিএলের একটি ম্যাচে জুয়া ধরার এক পর্যায়ে টাকা শেষ হয়ে যায় এক ব্যক্তির। এলাকায় মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি একপর্যায়ে ৫ বস্তা চাল জুয়ায় ধরেন। জুয়ায় হেরে পরিচিত এক দোকান থেকে দাবি পরিশোধ করেন।
বিপিএল নিয়ে জুয়ার কারণে রাজধানীতে ঘটেছে প্রাণহানিও। গত ৬ নভেম্বর জুয়ায় বাধা দেওয়ায় খুন হন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম। এছাড়া প্রতিনিয়ত মারামারি কিংবা নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন দিন-রাত কাজ করেন অসংখ্য দিনমজুর ও শ্রমিক। এখানে রয়েছে শতাধিক চায়ের টং দোকান। বেশিরভাগ দোকানেই আছে টিভি। সাধারণ সময়ে সিনেমা চললেও খেলার সময়ে অন্য সবকিছুই বন্ধ। ভিড়ও বাড়ে সেসময়। দোকানির বেচা-বিক্রিও হয় বেশ ভালো। তবে এখানে যারা খেলা দেখেন, তাদের অধিকাংশেরই নেই ক্রিকেটীয় জ্ঞান কিংবা আগ্রহ। শুধু জুয়া ধরার কারণেই তারা খেলা দেখেন। প্রতি বল থেকে শুরু করে ম্যাচ পর্যন্ত, সব কিছু নিয়েই হয় জুয়া। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা পর্যন্ত জুয়া খেলা হয় এ এলাকায়।
মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে হয় দোকানিদের মধ্যে জুয়া। কোনো খেলা হলেই এখানকার অনেক ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে জুয়া ধরেন। এখানে জুয়া হয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে।
এছাড়াও রাজধানীর নীলক্ষেত, গুলিস্তান, সদরঘাটসহ সব এলাকাতেই জুয়ার আসর বসে।
গত শুক্রবার মিরপুরের শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জুয়া খেলার সময় বিদেশিসহ ৭৭জনকে আটক করেছে বিসিবি। পরে তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্টেডিয়ামের বাইরে জুয়া খেলা হলে তাদের কিছু করার নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এখনই এসব জুয়ার লাগাম টানা না গেলে অদূর ভবিষ্যৎতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
টং দোকানের জুয়ার চেয়ে ভয়াবহ জুয়ার আসর বসে সবার অলক্ষ্যে। পরিচিতদের মধ্যে মোবাইলে যোগাযোগের সূত্রে ধরা হয় জুয়ার বাজি। এরকম জুয়া সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি প্রিয়.কমকে, এসব ক্ষেত্রে লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
তার কাছে জানা যায়, চলতি বিপিএল ঘিরেই এরকম বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তবে শুধু বিপিএল না, সারা বছর ধরে চলতে থাকা বিভিন্ন খেলা নিয়েই চলে জুয়ার রমরমা বাণিজ্য।
আর পেশাদার জুয়াড়িদের নিয়মিত আসর বসে বিভিন্ন হোটেল কিংবা বারে। এসবের সর্বশেষ সংযোজন অনলাইনে জুয়ার আসর। বিভিন্ন বিদেশি সাইটে এখন বাংলাদেশ থেকেই অংশ নিচ্ছেন জুয়াড়িরা। অর্থ পরিশোধে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক কার্ড। পরামর্শক হিসেবে আছে বেশ কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ।
‘বেট ৩৬৫ আড্ডা বাংলাদেশ’ নামের এ রকম একটি গ্রপের সদস্য সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ অনলাইন বেটিং, বিপিএল বেটিং টিপস নামের এ রকম দুটি পেজ ঘুরে দেখা যায়, অনলাইনে টাকা পরিশোধের বিভিন্ন উপায় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। রয়েছে নিরাপদে জুয়া খেলে যাওয়ার বিভিন্ন পরামর্শ।
অনলাইনে জুয়া খেলার জন্য প্রথমে নিবন্ধন করতে হয়। কয়েকটি সাইট আবার নিবন্ধনের জন্য প্রাইজমানিও দিয়ে থাকে।
রাজধানীর জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণ পদ রায় প্রিয়.কমকে বলেন, ‘জুয়ার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এটা নিষিদ্ধ। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া আছে। সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে যারা জুয়া পরিচালনা করছেন, তারা আমাদের নজরদারিতে আছেন।’
বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত জুয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাড়া মহল্লায় যেসব জুয়া হয় তা পুলিশের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার।’
কোথাও কোনো জুয়ার আসর দেখলে তা পুলিশকে জানানোর জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান কৃষ্ণ পদ রায়।
বিপিএলের জুয়াড়িদের বিষয়ে গত শুক্রবার বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশে ক্রিকেট নিয়ে যে জুয়া হচ্ছে তা নিয়ে বিসিবির কিছু করার নেই। তবে স্টেডিয়ামের ভেতর জুয়া বন্ধে তৎপর রয়েছে ক্রিকেট বোর্ড।
প্রিয় সংবাদ/জন/রিমন