কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বন্যায় বসতভিটা ডুবে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ। ছবিটি জামালপুরের ইসলামপুর থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

ভারতের পানিতেই বাংলাদেশে বন্যা

আবু আজাদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০১৭, ১৩:২৮
আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০১৭, ১৩:২৮

(প্রিয়.কম) টানা বর্ষণে ভারতের আসাম প্রদেশ ও নেপালের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর অবস্থিত গজলডোবা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দিয়েছে। ফলে পাহাড়ি ঢলের ওই পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করায় দেশের বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক আকার ধারণ করছে।

দেশের অন্যতম প্রধান ও উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা, আত্রাইসহ অন্যান্য প্রধান নদ-নদীতে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভেঙে গেছে অসংখ্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এতে ২১ জেলার লাখ লাখ মানুষ ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছে।

পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বাঁধ মেরামত ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সময়ের সাথে বন্যার প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজধানী ঢাকাতেও বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলত ভারত গজলডোবা বাঁধের সবগুলো (৫৪টি) গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে ভয়াবহ এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড (পাউবো) নদীটির বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে।  

 

ম্যাপে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি। ছবি: সংগৃহীত

মানচিত্রে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি। ছবি: সংগৃহীত

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকবে। ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার ৯টা পর্যন্ত গত চব্বিশ ঘণ্টায় দেশের ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ৪৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ৪০টি পয়েন্টে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া ২৮টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

১৭ আগস্ট বুধবার সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

চিত্র

কোন নদীতে বিপদসীমার কত ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি

এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৪ সেমি, বদরগঞ্জে যমুনেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৪৫ সেমি, গাইবান্ধায় ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৭৩ সেমি, যমুনা নদীর পানি বাহাদুরবাদে বিপদসীমার ১২১ সেমি, যমুনা নদীর কাজীপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫৪ সেমি, পুরাতন সুরমার পানি জারিয়াজঞ্জালে বিপদসীমার ১২০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ঘর ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। কিন্তু পাট বাঁচাতে ঘরের চালে শুকাতে দেওয়া হচ্ছে। ছবিটি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

ঘর ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। কিন্তু পাট বাঁচাতে ঘরের চালে শুকাতে দেওয়া হচ্ছে। ছবিটি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

এদিকে দেশের মধ্যাঞ্চলে পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দে বিপদসীমার ৯৩ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী-ফরিদপুর অঞ্চলে নতুন করে বন্যার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. গোলাম মোস্তফা বুধবার জানিয়েছেন, বন্যায় ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২১ জেলার ৩২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর ফসলি জমি, নদীগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে ৮ হাজার ১৪০টি ঘরবাড়ি। এছাড়া ২১ জেলায় এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যাতে ইতোমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ। ভয়াল এ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৭ জন মানুষ। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে বন্যায় মৃত্যের সংখ্যা ৫৮।

ভারতের সিকিমে তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের সিকিমে তিস্তা। ছবি: সংগৃহীত

বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ভারতের আসামের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-বরাক নদীর উপত্যকায় অবস্থিত ১১ জেলার ১১০০ গ্রামে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে অন্তত ১০৮ জন নিহতসহ প্রায় ৫ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপর দিকে নেপালেও বেশ কিছু অঞ্চল এখনো পানির নীচে রয়েছে  দক্ষিণাঞ্চলে ৪৮,০০০ বাড়ি পুরোপুরি পানির নীচে তলিয়ে গেছে। ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১১০জন ছাড়িয়ে গেছে। ভারত ও নেপালের এই বন্যার পানি ভাটিতে নেমে আসার পর বাংলাদেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে।

ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, একইভাবে প্রতিবছরই বর্ষার সময় ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হলে গজলডোবার ৫৪টি জলকপাট খুলে দেয় ভারত। এতে কুড়িগ্রাম,নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত এবং ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এর আগে ২০১৬ সালে ভারত গজলডোবা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দিলে দেশের উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ১৯৯৮ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে ৬০ কিলোমিটার উজানে সিকিমের গজলডোবায় তিস্তা নদীর ওপর একটি বাঁধ নির্মাণ করে। উজানে বন্যা হলে এ বাঁধের ৫৪টি গেটের সব কটি খুলে দেয় ভারত। এতে বাংলাদেশের তিস্তার দুকূল প্লাবিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অপরদিকে, শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের সাহায্যে তিস্তার পানি আটকে তা প্রত্যাহার করে নেয় এবং ওই পানি তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে দীর্ঘ ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার বয়ে ভারতের উত্তরাঞ্চলের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, কুচবিহার ও মালদাহ জেলার ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়।

এভাবে বছরের পর বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে। ওই সময়ে পানির জন্য কৃষকের হাহাকার চরম রূপ করে, ফসল ফলাতে পারে না। অপরদিকে, বর্ষায় বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে প্রবল বন্যার সৃষ্টি করে, ঘটে প্রচুর প্রাণহানী-ফসলহানী, লাখ লাখ মানুষ পানি বন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটায়।

আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ, শুষ্ক মৌসুমে পানি না দিয়ে মরুকরণের সৃষ্টি এবং বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলোর সব গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি করায় ভারতকে সরাসরি দায়ী করেন অনেকেই। অনেকের মতে, ভারতের বিমাতাসুলভ এ আরচণ কখনো বন্ধুত্বের নমুনা হতে পারে না।   

স্যাটেলাইটের ছবিতে সিকিমে অবস্থিত গজলডোবা বাঁধ।

স্যাটেলাইটের ছবিতে সিকিমে অবস্থিত গজলডোবা বাঁধ। 

ভারত থেকে আসা পানিতে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. ফিরোজ আহমেদ প্রিয়.কমকে বলেন, ভারত বন্যা থেকে নিজেকে বাঁচাতে গজলডোবার সব গেট খুলে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশও বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু এবারের বন্যার পানির উৎস শুধু ভারত নয়, নেপালও। কিন্তু প্রতিবছর নিজেকে বাঁচাতে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং একই সাথে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কেবল সাময়িক উপশম। কিন্তু স্থায়ী কোনো লাভ হচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, উপমহাদেশের ভারত-নেপাল-ভুটান ও বাংলাদেশের যে কোনো একটি দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রন করতে গেলে অপর তিনটি দেশেরই সহায়তা প্রয়োজন। কেননা ওই বাংলাদেশ ব্যাতীত অপর তিনটি দেশের যে কোন একটি দেশে সৃষ্ট ঢল বাংলাদেশসহ অপর দেশগুলোতে বন্যা সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে চারটি দেশ যৌথভাবে পানির উৎসের দেশগুলো পানি রিজার্ভার তৈরী করতে হবে। যা বর্ষা মৌসুমে বন্যা থেকে বাঁচাবে অপর দিকে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যাবে। অপরদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই নদীখনন করে পানি প্রবাহ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।  

বাঁধের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী। ছবি: সংগৃহীত

বাঁধের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী। ছবি: সংগৃহীত

তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে দেশের অভ্যন্তরে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগের পাশাপাশি ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের (নেপাল-ভুটান) সাথে আলোচনার ওপর জোর দিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন কবির প্রিয়.কমকে বলেন, বাংলাদেশের বন্যার পানির প্রধান উৎস উজানের দেশগুলোর (ভারত-নেপাল-ভুটান) পানি। প্রতিবছরই বন্যায় সব দেশই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে নেই কোনো সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা। অথচ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রন করা যাবে অন্যদিকে পানির সর্বোত্তম ব্যবহারও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ড্রেজিং, বাঁধ নির্মাণ, রিজার্ভার খনন, নদী শাসন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশই উভয়ের ভাল বন্ধু হিসেবে দাবি করে আসছে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশকে সাথে নিয়ে যৌথভাবে বিষয়টি সমাধানের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাংলাদেশ ভারতে অনুরোধ জানাতে পারে। উদ্যোগটি আমাদেরকেই নিতে হবে, কেননা আমরাই সবচেয়ে ভুক্তভোগী। এ ক্ষেত্রে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনাই জরুরি।  

 প্রিয় সংবাদ/রিমন