কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

মেহেদী হাসান মিরাজ। ছবি: প্রিয়.কম

যে পাঁচ কারণে ক্রিকেট বিশ্বের নজরে রয়েছেন মিরাজ

সৌরভ মাহমুদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৪০
আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৪০

(প্রিয়.কম) তার জীবনের শুরুতে ছিল না কোন রুপকথা। ছিল না পরতে পরতে কোন রোমাঞ্চের ছোঁয়া। বাংলাদেশের আর দশটা পরিবারের মতোই টানাটানির সংসারে জন্ম তার। গাড়িচালক বাবা চেয়েছিলেন ছেলে পড়ালেখা করুক। কিন্তু রূপসাপাড়ের সেই ছোট্ট ছেলেটির চিন্তাভাবনা ছিল ভিন্ন। লেখাপড়ার চেয়ে ক্রিকেটটাই বেশি টানে তাকে। ক্রিকেটের জন্য ছেলেবেলায় বাবার মারও খেয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বাবার বেদম মার উপেক্ষা করেও বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেটের বিলাসিতা। ফলাফল, মাত্র ১৯ বছর বয়সেই পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলা হচ্ছে, বিস্ময় বালক মেহেদী হাসান মিরাজের কথা।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিষেক থেকেই যিনি মুগ্ধ করে রেখেছেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে! যদিও ক্রিকেটে মিরাজের উত্থানটা কোনভাবেই নাটকীয় নয়। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে দুইবার বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ব্যাটে-বলে নৈপুণ্য দেখিয়ে একবার হয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক। অভিষেক টেস্টে সাত উইকেট, পরের টেস্টে ১২ উইকেট। দুই ম্যাচের সিরিজে মোট ১৯ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ড দলের জন্য এক সারপ্রাইজ প্যাকেজ হয়েই ধরা দেন ডানহাতি এই অফ স্পিনার। 

টেস্ট অভিষেকের পাঁচ মাসের মাথায় মিরাজের মাথায় ওঠে ওয়ানডে ক্যাপও। রঙিন পোশাকেও নিজের প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। ৪৩ রানে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ঝুলিতে পুরে নেন দুই উইকেট। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও কার্যকরী মিরাজ। যদিও ব্যাট হাতে এখনও নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করা হয়নি। মিরাজের টি-টোয়েন্টি অভিষেক ঘটে মাশরাফি বিন মুর্তজার বিদায়ী ম্যাচে। যদিও টেস্ট কিংবা ওয়ানডে অভিষেকের মতো ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণটা স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। বল হাতে পাননি উইকেটের দেখা। ব্যাটও চালাতে পারেননি।

অভিষেকের পর পার হয়ে গেছে অনেকগুলো দিন। মিরাজের নামের পাশে লেখা হয়েছে নয়টি টেস্ট, ছয়টি ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি। এখন পর্যন্ত খেলা নয় টেস্টে মিরাজ ঝুলিতে পুরেছেন ৪৩টি উইকেট। ছয় ওয়ানডেতে তার শিকার পাঁচ উইকেট। ব্যাট হাতে দুই ফরম্যাটেই রয়েছে একটি করে হাফ সেঞ্চুরি। বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে অন্যতম সেরা অফ স্পিনার ভাবা হয় তাকে। সেই সঙ্গে আছে কার্যকরী ব্যাটিং জ্ঞান। সব মিলিয়ে তাই শুধু বাংলাদেশই নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্বের নজর রয়েছে ১৯ বছর বয়সী বাংলাদেশি এই বিস্ময় বালকের উপর।

ক্রিকেট বিশ্বের নজরে থাকা সেই মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়েই প্রিয়.কমের আজকের আয়োজন। চলুন দেখে নিই ঠিক কোন পাঁচ কারণে এই ডানহাতি অলরাউন্ডার আজ ক্রিকেট বিশ্বের নজরে। 

সহজ অ্যাকশন, বেসিক মেনে বোলিং করা: 

অভিষেক টেস্টেই তাক লাগিয়ে দেন মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

অভিষেক টেস্টেই তাক লাগিয়ে দেন মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

তরুণ স্পিনাররা বোলিংয়ে প্রায়ই নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। এই নতুনত্ব আনতে গিয়ে করে ফেলে বাজে বল। সুযোগ বুঝে ব্যাটসম্যান সেই বোলারের উপর চড়াও হন। এই সাধারণ ভুলটার কারণেই অনেক তরুণ প্রতিভাবান নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছেন। এক্ষেত্রে মিরাজকে ব্যতিক্রমই বলা যায়। কেননা মিরাজ খুব সহজ অ্যাকশনে বল করে থাকেন। বেসিক মেনে উইকেট বুঝে নিজের বোলিং দিয়ে নাজেহাল করেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের।

সহজ হলেও মিরাজের বোলিং অ্যাকশনে রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। বল করার আগ মুহূর্তে একটু থেমে শরীরের উপরিভাগটা কিছুটা ঘুরিয়ে বল ছাড়েন। যা তার বোলিংয়ের শক্তি আরও বাড়িয়ে দেয়। সহজ বোলিং অ্যাকশন ছাড়াও উইকেট থেকে সর্বোচ্চ সুযোগটা আদায় করে নেন মিরাজ। উইকেটের অবস্থা বুঝে বেসিক মেনে উইকেট টু উইকেট বল করে থাকেন ডানহাতি এই অফ স্পিনার। এছাড়া ফিল্ডিংয়ের অবস্থান বুঝে ব্যাটসম্যানকে প্রলুব্ধ করে থাকেন। যা তার উইকেট শিকারে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

সহজাত অ্যাকশন সঙ্গে উইকেট বুঝে বোলিং- তাকে সময়ের অন্যতম সেরা অফ স্পিনারদের কাতারে নিয়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে রবিচন্দ্রন অশ্বিন, নাথান লায়ন, দিলরুয়ান পেরেরা ও মঈন আলীদের সঙ্গে এই অফ স্পিনারের দিকেও নজর পুরো ক্রিকেট বিশ্বের।  

চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান বোলার:

পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও শানিত ও ক্ষুরধার করছেন মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও শানিত ও ক্ষুরধার করছেন মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুধুমাত্র প্রতিভা দিয়ে বেশি দিন টেকা যায় না। প্রতিভার পাশাপাশি কঠিন পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়তা, বিচার বিশ্লেষণ ও অধ্যাবসায় একজন ক্রিকেটারকে আরও ক্ষুরধার করে তোলে। অন্যথায় হারিয়ে যেতে হয়। কথাটা মানেন মিরাজও। তাই তো শুধুমাত্র নিজের প্রতিভা নিয়েই পড়ে থাকেননি তিনি। পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নিজেকে আরও শানিত ও ক্ষুরধার করছেন প্রতিনিয়ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সর্বশেষ ঘরের মাটিতে টেস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথকে সাজঘরে ফেরাতে নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণকে কাজে লাগিয়েছেন মিরাজ।

কয়েকদিন আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে আর্ম বলে স্মিথকে পরাস্ত করেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সেই বলের কথা মনে রেখেছিলেন মিরাজ। পরবর্তীতে টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ এই ব্যাটসম্যানের মুখোমুখি হওয়ার আগে আলাদা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন মিরাজ। ফলাফল, ঢাকা টেস্টের প্রথম ইনিংসে একই ভাবে রাউন্ড দ্যা উইকেটে এসে আর্ম বলে স্মিথকে সরাসরি বোল্ড করে সাজঘরে ফেরান তিনি। নির্দিষ্ট ব্যাটসাম্যানকে ফেরাতে এমন কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা ১৯ বছর বয়সী এই অফ স্পিনারকে আরও ক্ষুরধার করেছে। ম্যাচ শেষে জানিয়েছিলেনও, পরিকল্পনা করেই স্মিথকে ফিরিয়েছেন তিনি।

প্রতিভার বাইরেও এমন বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা মিরাজকে এনে দিয়েছে সাফল্য। প্রতিপক্ষকে বিচার করেই দুর্বলতা বের করে আনার এই ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়েছে, সহজেই হারিয়ে যেতে আসেননি মিরাজ।

ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা:

স্টিভেন স্মিথকে সাজঘরে ফেরানোর পর মিরাজকে ঘিরে সতীর্থদের উদযাপন। ছবি: সংগৃহীত

স্টিভেন স্মিথকে সাজঘরে ফেরানোর পর মিরাজকে ঘিরে সতীর্থদের উদযাপন। ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক স্পিনারদের মতো নির্দিষ্ট রহস্য বল দিয়ে উইকেট শিকার নয়, বরং বৈচিত্রপূর্ণ বোলিং দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে ফেরানো বেশি পছন্দ মিরাজের। বৈচিত্রপূর্ণ বোলিংয়ের পাশাপাশি ফ্লাইট দিয়ে বারবার ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করে থাকেন তিনি। শুধু তাই নয়, ফ্লাইটের পাশাপাশি উইকেটের সর্বোচ্চ সুবিধাটুকু নিয়ে বলকে একটু জোরে ছেড়েও ব্যাটসম্যানকে হতবিহ্বল করে দেন মিরাজ। এই কাজটাই তিনি করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্টে। ইংলিশদের ছয় উইকেট তুলে নেওয়ার সেই ম্যাচে বারবারই ফ্লাইট ডেলিভারি আর জোরের উপরে করা বল দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করেছেন মিরাজ।

সর্বশেষ ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও বল হাতে ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন বাংলাদেশি এই অফ স্পিনার। ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করার এই গুণ ডানহাতি এই অফ স্পিনারকে আর এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে। 

বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও পারদর্শী:

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট হাতে মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট হাতে মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ যুব বিশ্বকাপে বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতে দেখিয়েছেন অসাধারণ পারফরম্যান্স। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের হয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরাও। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর শুরুতে নিষ্প্রভই ছিলেন 'ব্যাটসম্যান' মিরাজ। তবে ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক টেস্টে নিজেদের প্রথম ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণ দেন ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। এরপর লঙ্কানদের বিপক্ষে রঙিন পোশাকে হাফ সেঞ্চুরি করে আবারও নিজের জাত চেনান এই অলরাউন্ডার। দুই ফরম্যাটেই তার সর্বোচ্চ সংগ্রহ ৫১ রান।

অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের কারণে অনেকে তাকে ভবিষ্যতের সাকিব আল হাসান বলেও অভিহিত করেন। বোলিংয়ের পাশাপাশি এমন কার্যকরী ব্যাটিং নিঃসন্দেহে মিরাজেকে এগিয়ে রাখবে। জাতীয় দলে নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া মিরাজ নিজেও বোলিংয়ের পাশাপাশি কাজ করছেন ব্যাটিং নিয়ে। ব্যাটিং-বোলিংয়ে সমান পারদর্শী একজন ক্রিকেটার যে কোন দলেরই মূল শক্তি হিসেবে বিবেচিত। তাই তো সাকিবের পর মিরাজের উপরও প্রতিটি সিরিজে নজর থাকছে ক্রিকেট বিশ্বের। 

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কান্ডারি:

 সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

বল হাতে আক্রমণ শুরুর গুরু দায়িত্ব, ব্যাট হাতে স্কোর বোর্ডকে টেনে নিয়ে যাওয়া, দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া; সব গুনই আছে ১৯ বছর বয়সী মিরাজের মাঝে। যুব বিশ্বকাপে ব্যাটিং-বোলিংয়ের অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে জিতে নিয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। একই সঙ্গে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে তৃতীয় স্থান (যুব বিশ্বকাপে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য) এনে দিয়ে অধিনায়ক হিসেবেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন মিরাজ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবেও তাকে ভাবনায় রেখেছেন অনেকে।

এখনই মিরাজকে জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে চিন্তা করাটা অমূলক নয়। বাংলাদেশ দলের বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের বয়স এখন ৩০। ওপেনার তামিম ইকবালের বয়স ২৮ পেরিয়ে। বাংলাদেশ দলের 'পোস্টার বয়' সাকিবের বয়সও এখন ৩০ পেরিয়ে। বলা যায়, আরও পাঁচ বছর অনায়াসেই খেলবেন মুশফিক-তামিম-সাকিবরা। নিশ্চিতভাবেই সিনিয়র ক্রিকেটারদের অধীনে থেকে আগামী পাঁচ বছরে মানসিকভাবে আরও পরিণত হয়ে উঠবেন মিরাজ। সাকিব-তামিমরা অবসরে গেলে দলের অধিনায়কের গুরু দায়িত্ব উঠতে পারে তখন ২৪-২৫ বছরে পা দেওয়া মিরাজের কাঁধেই। এখন থেকেই দলের হাল বোঝা তরুণটা নিঃসন্দেহেই তখন দলের দায়িত্ব সামলে নিতে পারবেন বলে আশা করা যায়!

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের যিনি কান্ডারি হবেন, তার ওপর ক্রিকেট বিশ্বের নজর থাকাটাই স্বাভাবিক! 

প্রিয় স্পোর্টস/শান্ত মাহমুদ