কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ভ্রমণে ঘটতে পারে অনেক কিছুই, আর তাই আপনাকেও থাকতে হবে প্রস্তুত! ছবি: সংগৃহীত।

ভ্রমণের জন্য ফার্স্ট এইড কিট: জরুরী অবস্থায় বাঁচাতে পারে আপনার জীবন

খন্দকার ইশতিয়াক মাহমুদ
লেখক
প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:২০
আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:২০

(প্রিয়.কম) এডভেঞ্চার ট্রিপ হোক আর আরাম আয়েশ ট্রিপ হোক, দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না, আর দুর্ঘটনার সময় হাতের কাছে জরুরী চিকিৎসার সবকিছু পাবেন, এটাও সবসময় হয় না। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হল নিজেই সাথে করে একটি ফার্স্ট এইড বক্স বা ব্যাগ রাখা, যেন ভ্রমণের সময় জরুরী অবস্থায় অন্তত যেন প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু দেয়া যায়।

আবার আপনি যখন এডভেঞ্চার ট্রিপে যাবেন, তখন আপনাকে নিতে হবে বাড়তি কেয়ার। এডভেঞ্চার ট্রিপ মানেই হাইকিং বা ট্রেকিং, বনে বাদাড়ে একা বা কয়েকজনে মিলে ঘুরে বেড়ানো। যেখানে আপনাকে হতে হবে পুরোপুরি স্বনির্ভর, জানতে হবে যে, কোনও সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য আপনি নিজে বা দলের সদস্য ছাড়া আর কারও উপরে নির্ভর করতে পারবেন না, বেশিরভাগ সময়ই ভরসা করতে হবে কেবলমাত্র নিজের দক্ষতা ও প্রস্তুতির উপরেই।

এডভেঞ্চার ট্রিপে যে জিনিসটি সবসময়ই সাথে রাখতে হবে সেটা হল ফার্স্ট এইড বক্স। ফার্স্ট এইড বক্সে কিছু ওষুধপত্র থাকে, কিছু জিনিস থাকে যেগুলো নিয়ে আপনি প্রাথমিক ভাবে ছোটখাটো দুর্ঘটনার মোকাবেলা করতে পারবেন। বেশিরভাগ সময় কাটা ছেড়া বা সামান্য রক্তপাত এর জন্য ফার্স্টএইড বক্সে থাকা জিনিসপত্রই যথেষ্ট। যেগুলোর জন্য ফার্স্ট এইড বক্স যথেষ্ট নয়, সেগুলো ক্ষেত্রেও এটা প্রাথমিকভাবে অবস্থা সামাল দেবার কাজে ব্যাবহার করা যায়, কিছু সময় পাওয়া যায় যেটা ব্যবহার করে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষটিকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।

 

ফার্স্ট এইড বক্স আসলে কী?

ফার্স্ট এইড কিট হল একটা ছোট্ট বহনযোগ্য বাক্স, যাতে একজন মানুষ কোন ভাবে আহত হলে তাকে জরুরী ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যায়। ফার্স্ট এইড বক্স খুব সাংঘাতিক জিনিস নয়, চাইলে আপনিও বাড়িতে বসে বানিয়ে নিতে পারেন এই সাধারণ কিন্তু মহা জরুরী জিনিসটা। এটা যে একটা বাক্সই হতে হবে, তাও নয়, এটা হতে পারে একটা ব্যাগও। তবে যেটা দিয়েই বানানো হোক, জিনিসটা যেন এক নজরেই চেনা যায় সেভাবে বানাতে হবে, তাই উজ্জ্বল রং এর হলে ভালো হয়। একটা পানি-রোধী ব্যাগ হলে সবচেয়ে ভালো হয়, কিন্তু না থাকলে সাধারণ ব্যাগে পলি-প্যাক দিয়েও আপনি কাজটি করতে পারবেন। এই কাজে জিপ-লক ব্যাগ সাধারণ পলি-ব্যাগের চেয়ে বেশি কাজের।

এই ফার্স্ট এইড বক্সে কি থাকে? সেটা নিয়েই আমরা আলোচনা করব। একেক এলাকার জন্য ফার্স্ট এইড বক্স একটু ভিন্ন ভিন্ন হয়, তবে প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো সবজায়গাতেই একই থাকে। রেডক্রস এর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তালিকা থেকে ধারনা নিয়ে বাংলাদেশে বসে তৈরি করা সহজ এরকম একটি তালিকা এখানে দেয়া হল।

১. গজ ব্যান্ডেজ: রোল আকারে পাওয়া যায় এই গজ ব্যান্ডেজ গুলো। সাধারণ মেডিসিনের দোকানেই পাওয়া যায়, দামও বেশি নয়। খোলা ব্যান্ডেজ থেকে থেকে পলি প্যাকে যেগুলো বিশুদ্ধিকরণ করে রাখা হয়, সেটাই সবচেয়ে ভাল ও নিরাপদ হবে।

২. তুলা: তুলাও ছোট ছোট প্যাকেটে পাওয়া যায়। আবার বড় প্যাকেটেও পাওয়া যায়, তবে একটা বড় প্যাকেটর তুলনায় কয়েকটা ছোট প্যাকেটের তুলা রাখাই ভাল। কারণ সেগুলো ধুলাবালি মুক্ত থাকে আর দরকারে ছোট প্যাকেট বেশি বেশি রাখা যেতে পারে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য প্যাকেট তুলাই সবচেয়ে ভাল।

৩. সার্জিকাল টেপ: সার্জিকাল টেপ, যেগুলো দিয়ে সহজেই ক্ষতের উপরে ব্যান্ডেজ আটকে রাখা যায়, এছাড়া অন্য কাজেও ব্যাবহার করা যায় এগুলো। দেখতে সাধারণত কমলা রং এর হয়ে থাকে। আবার কতগুলো সাদাও হয়ে থাকে।

বিভিন্ন ধরনের ব্যান্ড-এইড কাজে আসতে পারে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতে। ছবি:সংগৃহীত।

৪. ব্যান্ড-এইড: আমরা ব্যান্ড-এইড বলতে ছোট্ট একটা জিনিস বুঝি, ছোট আকারে কাটা ছেড়ায় ব্যাবহারের জন্য। কিন্তু একটু খুঁজলে আপনি বড় বড় আকারের ব্যান্ড-এইড পেয়ে যাবেন, আর চটজলদি কাটা ছেড়া বা ছড়ে যাওয়ায় ব্যবহার করার জন্য এগুলো খুব চমৎকার কাজ দেয়। বেশ বড় আকারের ক্ষতে চট করে ব্যান্ডেজ করে দিতে এই বড় আকারের ব্যান্ড-এইডগুলো অত্যন্ত কাজের।

৫. কাচি ও সার্জিকাল নাইফ: সার্জিকাল কাচি একটু ভিন্ন রকম হয়, মাথাটা বা শার্প অংশটি একটু ছোট হয় শরীরের তুলনায়। পুরোপুরি ধাতব এই জিনিসটা দিয়ে অনেক কিছুই কাটা যায়, ব্যান্ডেজ, তুলা, কাপড় ইত্যাদি। আবার অন্যদিকে সার্জিকাল নাইফ একটা ধারাল ব্লেড এর মত, এটা দিয়ে অনেক সময় ক্ষত কাটাকাটি করতে হয়। এটি অত্যন্ত ধারালো হয়ে থাকে, তাই সাবধানে ব্যবহার করা উচিত।

৬. চিমটা: অনেক সময় ক্ষতে ময়লা থাকে, যেগুলোকে তুলা দিয়ে মুছে ফেলা যায় না আবার পরিষ্কার পানিও পাওয়া যায় না আশে পাশে যে আপনি ধুয়ে ফেলবেন। সেসব সময়ে একটা চিমটা অনেক কাজে আসতে পারে। আবার যদি কাঁচ এর ক্ষত হয়, তাহলেও অনেক সময় ক্ষতে কাঁচ থেকে যায়, সেগুলো পরে সাংঘাতিক বিপদের কারণ হয়ে দাড়ায়। চিমটার মত জিনিস থাকলে এগুলোও পরিষ্কার করা সম্ভব।

৭. সেফটি পিন: শুনতে মজার শোনালেও সেফটি পিন জিনিসটা কিন্তু মেডিকেল কাজে ব্যবহারের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। এখন আমরা তো যত্র তত্র ব্যবহার করি। ব্যান্ডেজ করার পরে সেটাকে বেধে দিতে বা কোন কিছুকে আটকে রাখতে এটা নিরাপদ-ভাবে ব্যবহার করা যায়। আপনার ফার্স্ট এইড বক্সেও এটা থাকলে অনেক কাজে আসবে।

ডিসপোজেবল গ্লাভস পারে ক্ষত ইনফেকশন হতে রক্ষা করতে। ছবি: সংগৃহীত।

৮. রাবার গ্লাভস: অনেক সময় হাতে ময়লা থাকে আর পরিষ্কার পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেবার কোন উপায়ও থাকে না, সে সময় চটজলদি সহযোগিতা করতে পারে রাবার গ্লাভস বা ডিসপোজেবল গ্লাভস। ক্ষত ময়লা হাত দিয়ে পরিষ্কার করার চেয়ে এটা পরে করা অনেক নিরাপদ, দুজনের জন্যই। সুবিধার জন্য বেশ কিছু রাবার গ্লাভস জিপ-লক ব্যাগে আলাদা করে রাখতে পারেন, যেন সেগুলো ময়লা না হয়ে যায়।

৯. ছোট্ট একটা টর্চ: কী হবে যদি দুর্ঘটনাটা ঘটে অন্ধকারে আর আপনার কাছে কোন আলো নেই? তাই সাথে থাকতে হবে একটা ছোট্ট টর্চ আর সেটার জন্য বাড়তি ব্যাটারিও রাখতে হবে সাথে। মাঝে মাঝেই চেক করে দেখতে হবে ব্যাটারি ঠিক আছে কী না।

১০. সাবান: যদি আপনি পরিষ্কার পানি পেয়েই যান, তাহলে ক্ষত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা বা সেটা চিকিৎসা করতে যাবার আগে নিজের হাত পরিষ্কার করে নেবার জন্য এন্টিসেপটিক সাবান বিশেষ কাজের। এছাড়াও অন্যান্য কাজে আসবে এই জিনিস।

১১. এন্টিসেপটিক: স্যাভলন বা ডেটল এর মত এন্টিসেপটিক সাথে রাখা জরুরী। হেক্সিসল বা জার্মিসল এর মত এলকোহল বেজড এন্টিসেপটিক রাখতে পারেন, যদিও এই জিনিসগুলো একটু বেশিই কড়া, তাই সরাসরি ক্ষতে দেবার চেয়ে বরং চিকিৎসার জিনিসপত্র ও হাত স্টেরিলাইজ করার জন্যও এটা দেয়া যায়। তবে সরাসরি এটা ক্ষতে না দেয়াই ভালো। এতে করে নরম টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

১২. থার্মোমিটার: জ্বর এলে পরিমাণ বোঝার জন্য এটা কাজে আসবে। অনেক সময় ইনফেকশন হয়েছে কী না, তা আগে থেকেই বোঝার উপায় হল জ্বর এর পরিমাপ বোঝা। একটা থার্মোমিটার কাজে আসতে পারে অনেক বেশি। কেনার সময় অবশ্যই খেয়াল করে সহজে ভেঙ্গে না যায়, এরকম থার্মোমিটার নিতে হবে।

একটি ভালো ম্যানুয়াল পারে বাঁচা মরার পার্থক্য গড়ে দিতে। ছবি: সংগৃহীত।

১৩. একটা ভাল ফার্স্ট এইড ম্যানুয়াল: আমরা অনেকেই ফার্স্ট এইড বক্স সাথে রাখি, কিন্তু জরুরী দরকারে এটার সঠিক ব্যবহার করতে পারব তার গ্যারান্টি কি? আমরা আসলে কতটা জানি? সমস্যা হতে পারে হাজার রকমের, তাই একটা প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক বই বা ম্যানুয়াল সাথে থাকলে সেটা হতে পারে একটা জীবন রক্ষাকারী জিনিস। তবে বাজারে বই আছে অনেক রকমই, কেনার সময় দেখে নেবেন কোনটাতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এটাও খেয়াল রাখা জরুরী যে এটায় যেন একটা ভালো তালিকা থাকে, যেন চট করে খুঁজে নেয়া যায় কোন সমস্যা কোন পাতায় আলোচনা করা হয়েছে।

১৪. ওষুধ: যদিও কখন কি ওষুধ লাগবে আগে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু কিছু প্রাথমিক ওষুধ আছে যেগুলো আপনি বাক্সে রাখলে অনেক কাজেই লাগানো যাবে। ব্যথানাশক ওষুধ, পেট খারাপের ওষুধ, মাথা ধরার ওষুধ ইত্যাদি রাখলে অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবেন।

১৪. পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট: একজন মানুষের প্রতিদিন ঠিকভাবে শরীর সুস্থ রাখার জন্য দুই লিটার পানি কমপক্ষে গ্রহণ করতে হয়। জরুরী অবস্থায় বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ অত্যন্ত জরুরী একটা জিনিস। পানি পেলেও তা পান করা নিরাপদ নয়, কারণ এর মাধ্যমে ডায়রিয়ার মত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যেতে পারেন পানি শূন্যতায়। তাই পানি বিশুদ্ধ করার জন্য সাথে রাখুন বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট।

১৫. অন্যান্য: এই জিনিসগুলো আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না, কিন্তু বিপদে পড়লে বোঝা যায় আসলে এগুলো কতটা জরুরী। যখন কোন ট্রিপে যাচ্ছেন, যারা যারা যাচ্ছেন, তাদের সবার নাম ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ, জরুরী অবস্থায় তার পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর, যেখানে যাচ্ছেন, সেই এলাকার কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকের যোগাযোগ নাম্বার, কোন পরিচিত ডাক্তারের ফোন নম্বর রাখতে পারেন। একটা ছোট্ট নোটবুকে এসব তথ্য টুকে রাখুন, সাথে পেন্সিলটাও রেখে দিন। কিছু টাকা একটা প্যাকেটে করে রেখে দিন, জরুরী অবস্থায় টাকা অনেক কিছুই করতে পারে।

এলাকা ভেদে ফার্স্টএইড বক্সের জিনিস বাড়তে পারে। যেসব এলাকায় সাপের উপদ্রব আছে, সেখানের জন্য বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন বিশেষ পোকামাকড় প্রবণ এলাকায় গেলে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কোন এলাকায় কোন বিশেষ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকলে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, যেমন বান্দরবানের বেশ কিছু এলাকা আছে যেখানে যাবার সময় ম্যালেরিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়।

মনে হতে পারে অনেক কিছু নেয়া হয়ে গেল, খামোখা ওজনটা বেড়ে যাবে। কিন্তু দশদিন কাজে না লাগতে পারে, একদিন যদি দরকার হয়, হয়ত একটা মারাত্মক বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাবেন, একটা মানুষের জীবন বেঁচে যেতে পারে।

স্রেফ সচেতনতাই অনেক রকম বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে। আবার ফার্স্ট এইড বক্স থাকলেই হবে না, সেটা মাঝে মাঝে চেক করে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে এর সব কিছু ঠিকঠাক মত আছে কি না, যেটা ব্যবহার হয়েছে, সেটা আবার নিয়ে রাখা হয়েছে কি না, যে ওষুধগুলো আছে, সেগুলোর মেয়াদ ঠিক আছে কি না। এসব সচেতনতা না থাকলে অনেক সময় ফার্স্ট এইড বক্স নিজেই একটা বিপদের কারণ হতে পারে।

সম্পাদনা: ড. জিনিয়া রহমান।
ভ্রমণ সম্পর্কিত আরও জানতে চোখ রাখুন আমাদের প্রিয় ট্রাভেলের ফেসবুক পাতায়। 
ভ্রমণ নিয়ে আপনার যেকোনো অভিজ্ঞতা, টিপস কিংবা লেখা পোস্ট করুন আমাদের সাইটে । আপনাদের মতামত জানাতে ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।