কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

সুগারক্যাসলের বিখ্যাত সোনালু ফুলের কেক এবং সম্প্রতি তৈরি করা ব্যাগভর্তি ফুলের কেক। ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

শাওন আখতারের সুগারক্যাসল: মিষ্টি জাদুর চিনিরকেল্লা

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০২ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:০৬
আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:০৬

(প্রিয়.কম) ছেলেবেলায় এক বুড়ির গল্প আমরা সকলেই জানতাম। গহীন বনের মধ্যে সেই বুড়ি বিভিন্ন ধরণের ক্যান্ডি দিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। গল্পটা একজন ডাইনির হলেও অনেকেই খুব পছন্দ করতেন। তেমনভাবেই শাওন আখতার এর দারুণ ভালো লাগত গল্পটি। নিজের হাতে তৈরি কেকগুলো যেহেতু শিশুদের জন্য এবং অন্য সকলকে আনন্দ দেবার জন্যে তৈরি করা হয়, তাই তার মাথায় আসলো ভিন্নধর্মী একটি আইডিয়া। সেই বুড়ির ক্যান্ডি দিয়ে তৈরি ঘরের ভূতুড়ে ভাবকে কাটিয়ে মিষ্টি একটা ধারণা নিয়ে তৈরি করে তুললেন নিজস্ব চিনিরকেল্লা! যে চিনিরকেল্লা বর্তমানে “সুগারক্যাসল” নামে সুপরিচিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত।

চিনিরকেল্লা ১

সুগার ক্যাসেলের শিউলি ফুল ও বকুল ফুলের কেক। ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

সুগারক্যাসল এর কর্ণধার শাওন আখতার নিজের হাতে তৈরি কেক দিয়ে গড়ে তুলেছেন অনলাইন ভিত্তিক চমৎকার এই বেকারিশপটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন সমাজবিজ্ঞানে। এরপরে কিছুদিন কর্পোরেট দুনিয়ায় বিচরণ করে বুঝতে পেরেছেন ধরাবাঁধা চাকরি জীবন তার জন্যে নয়। কাজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করা শুরু করেন চাকরি জীবন থেকে সরে এসে। তবে বর্তমানে নিজের পড়ালেখার চাইতেও বেশী প্রাধান্য পাচ্ছে তার চিনিরকেল্লার সুগারক্রাফটিং এর নেশা।

দিনাজপুরের মেয়ে শাওনের সুগারক্রাফটিং এর নেশাটা মূলত শুরু হয়েছিল বেকিং এর প্রতি ভালোবাসা থেকেই। প্রথমদিকে পরিবার ও বন্ধুদের জন্যে কেক তৈরি করা হতো। এরপর তাদের উৎসাহ ও সাহস নিয়ে গড়ে ওঠে সুগারক্যাসল। তিনি যখন ফন্ডেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তখন বাংলাদেশে ফন্ডেন্ট কেকের প্রচলন একেবারেই ছিল না। ফলে বিভিন্ন বই পড়ে, ইউটিউবের ভিডিও দেখে নিজে থেকেই এমন চমৎকার কেক তৈরি করা শিখেছেন তিনি। অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেন, 'কোথা থেকে শিখেছেন তিনি এতো চমৎকার কেক তৈরি করা?' প্রতিবার উত্তরে জানান, তিনি একজন সেলফ ট্রেইনড বেকার। কেক তৈরির ক্ষেত্রে শাওন হলেন, 'সুগার ফ্লাওয়ার এক্সপার্টিজ'। বিভিন্ন ধরণের ফুল, বিশেষ করে দেশীয় ফুল নিয়ে কাজ করেন তিনি। যখন তিনি দেশীয় ফুল নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন স্বাভাবিকভাবেই সেটা তৈরির কোন টিউটোরিয়াল নেটে ছিল না। সুগার ক্রাফটিং এর মাধ্যমে ফন্ডেন্ট দ্বারা একটি দেশীয় ফুল তৈরি করার অ আ ক খ শিখেছেন একা কাজ করতে করতে! প্রচুর ভুল হয়েছে, জিনিস নষ্ট হয়েছে। আর সেভাবেই তিনি অপূর্ব সকল ফুলেল কেক তৈরি করা শিখেছেন। শুধু তাই নয়! এই সকল ফুল তৈরি করার কোন টুলস কোথাও পাওয়া যেত না। যে কারণে, নিজেই প্রয়োজনীয় সকল টুলস তৈরি করে নিয়েছেন পারফেক্ট ফুল তৈরি করার জন্য।

চিনিরকেল্লা ২

ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

নিজের কাজের ক্ষেত্র, সকলের অনুপ্রেরণা, সুগারক্যাসলের পথচলা নিয়ে চিনিরকেল্লার কর্ণধার বলেন, "এই কাজের জন্য কত অসংখ্য অপরিচিত মানুষের থেকে শুভকামনা পেয়েছি তার হিসেব নেই। সবচাইতে বেশি বোধ হয় সুগারক্র্যাফটিং এর জন্য আমার তীব্র ভালোবাসা। সামান্য একতাল চিনির দলা দিয়ে যখন স্নিগ্ধ একটা ফুল তৈরি করে ফেলা যায় আর সেটা কারো বিশেষ মুহুর্তকে সারাজীবনের জন্য স্মরণীয় আনন্দের মুহুর্ত করে ফেলে সেই আনন্দ তুলনাহীন। এই আনন্দটুকু খুব মূল্যবান। এটুকুর জন্য অসংখ্য বিপত্তি সয়েও এই কাজটা করে চলা যায়।"

ভালোবাসার কাজের সাথে শাওনের যাত্রার তিন বছর পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এর মাঝে বেশকিছু দিন সুগারক্যাসল বন্ধ ছিল ব্যক্তিগত ও শারীরিক অসুস্থতা জনিত কিছু সমস্যার কারণে। সকল সমস্যা ও বাধা-বিপত্তিকে পার করে আবারও পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে চিনিরকেল্লায়। দারুণ এই চিনিরকেল্লায় পাওয়া যাবে ক্রেতার পছন্দ ও রুচির ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন ফ্লেভার ও ডিজাইনের কাস্টমাইজড কেক। যার মূল্য শুরু হয় পঁচিশ’শ টাকা থেকে। যেহেতু প্রতিটি কেক এক একটি হ্যান্ড ক্রাফটিং, তাই সম্পূর্ণভাবে একটি কেক শেষ করতে বেশ অনেকটা সময় প্রয়োজন হয়। যে কারণে একটি কেক অর্ডার নেবার পর ডেলিভারি দেবার জন্য এক সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়ে থাকে। সুগারক্যাসেলের ফেসবুক পেইজ ঢু মেরে দেখা গেলো বর্তমানে চিনিরকেল্লায় রয়েছে দশ হাজারের বেশী লাইক। তবে সবচেয়ে চমতকৃত ব্যাপার হলো, পেইজের রেটিং পাঁচের মাঝে পুরোপুরি পাঁচ!

চিনিরকেল্লা ৩

ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

যেকোন উপলক্ষ্য, আয়োজনের জন্যেও কেক এর অর্ডার নিয়ে থাকেন শাওন। এমনকি উপলক্ষ্য ছাড়াও কেক তৈরি করা হয়। সাধারণ মিষ্টি মুখের জন্যে তৈরি করা হয়ে থাকে বিভিন্ন ধরণের কেক, কাপকেক, ব্রাউনি, মাফিন, কাপকেক, বারস এন স্লাইসেস ইত্যাদি। কাস্টমাইজ কেক তৈরির বিষয়ে দারুণ মজার একটি ঘটনা জানালেন শাওন। কিছুদিন আগেই একজন ক্রেতা তার পোষা কুকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কেক অর্ডার করলেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়! সেই কেক এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন কুকুর ও মানুষ সকলেই কেকটি খেতে পারবে! জেনে অবাক হবেন, শাওন দিন-রাত বিভিন্ন রেসিপি ঘেঁটে, বিভিন্ন তথ্য বের করে ডগ ফ্রেন্ডলি উপকরম দিয়ে ঠিকই এমন একটি কেক তৈরি করে ফেলেন, যা একইসাথে কুকুর ও মানুষ উভয়েই খেতে পারবেন! ক্রেতার কাছ থেকে এই কেকের জন্যে দারুণ ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছেন তিনি।

চিনিরকেল্লা ৪

ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী তৈরিকৃত স্পেশাল কেক। ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

নানান রকম টেক্সচার, অপ্রচলিত ফ্লেভার দিয়ে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর কেক তৈরির ভাবনা মাথায় রেখে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেন শাওন। কিছুদিন আগে রাঙতা মেলায় ‘মিষ্টিকুমড়া’ দিয়ে কেক তৈরি করেছিলেন। প্রথম দিকে অনেকে নাক কুঁচকালেও কেক খাওয়ার পরে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন সকলেই। মিষ্টিকুমড়ার পাশাপাশি বীট, জুকিনি, চালকুমড়া, গাজর, আলু, লেবু, নারিকেল, বিভিন্ন ধরণের বাদাম কেকে ব্যবহার করে স্বাদের মাঝে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেন তিনি প্রতিনিয়িত।

চিনিরকেল্লা ৭

ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

জনপ্রিয় সুগারক্যাসলকে যারা চেনেন তারা সকলেই এই কেল্লার বিভিন্ন ধরণের মনোহর কেকের ডিজাইনের ব্যাপারে জানেন। তবে সকল ডিজাইনের মাঝে ‘শিউলি ফুল’ এবং ‘সোনালু ফুল’ এর ডিজাইন সবচাইতে বেশী ক্রেতা পছন্দ ও সর্বাধিক বিক্রিত কেক। সোনালু ফুলের কেকটি সবচেয়ে বেশীবার তৈরি করতে হয়েছে শাওনকে। একইসাথে এই ডিজাইনটি দেশ-বিদেশের অনেক বেকাররাই নকল করেছেন। তন্মধ্যে কেউ কেউ অনুমতি নিয়ে সোনালু ফুলের কাজটি করলেও, অনেকেই বিনা অনুমতি কাজটি নকল করেন বলে জানান শাওন।

চিনিরকেল্লা ৫

জনপ্রিয় সোনালু ফুলের কেক। ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

নিজের সংসার, পড়ালেখা এবং নিজের প্যাশন নিয়ে একইসাথে কাজ করে এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর একটি ব্যাপার। বিশেষত, প্যাশনের জায়গাটি যখন ক্রিয়েটিভ কোন কাজ, তখন সেখানে প্রচুর সময় দেবার প্রয়োজন হয়। তবুও, এই সকল কিছু সামলে নিজের সবচাইতে প্রিয় কাজকে ধরে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন শাওন প্রতিদিন। কারণ, নিজের প্যাশন, নিজের সবচাইতে প্রিয় যে কাজটি সেটাকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। দিনশেষে নিজের প্রিয় কাজটির কাছেই ফিরে আসতে হয় সকল কিছুর শেষে।

চিনিরকেল্লা ৬

ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

তবে ব্যবসা ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েই যায়। এর মাঝে প্রধান সমস্যা হলো- কেক তৈরি ও কেকের ডিজাইনিং এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং র ম্যাটেরিয়ালের অপর্যাপ্ততা। দ্বিতীয়ত, এই সকল পণ্য কিনতে হয় ভীষণ চড়া মূল্যে। যে কারণে, কেকে মান ঠিক রেখে নিখুঁতভাবে কেকের ডিজাইন তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রায়শই হিমশিম খেতে হয় শাওনকে।

চিনিরকেল্লা ৮

ছবি কৃতজ্ঞতা: সুগারক্যাসল।

একটা সময় পর্যন্ত সকলেই বিদেশী থিমের উপরে কেক তৈরি করতেন, কেকে ডিজাইন করতেন। সেই প্রচলিত ধারা ভেঙে দেশীয় থিমের উপরে কেক তৈরি করার ধারণাটি সকলের মাঝে কাজ করাতে চেয়েছিলেন শাওন। যেটা সম্ভব হয়েছে তার তৈরি শিউলি ফুলের কেকটি দিয়ে। যার ধারাবাহিকতায় একে একে আমড়া, কচুরিপানা, মোহর, রসগোল্লা থিমেও কেক বানিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন ক্রেতাদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া। শাওনের চাওয়া- ভিড়ের মাঝে নিজেক আলাদা একজন হিসেবে পরিচিত করা এবং তার হাতে গড়ে ওঠা সুগারক্যাসলকে সকলের ভরসার ও ভালোবাসার একটি স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। 

প্রিয় লাইফ/ আর বি