কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

আমরা আমাদের জীবনকে কীভাবে ডিসরাপশন (disruption)-এর আওতায় আনতে পারি। প্রতীকী ছবি

জীবনে দ্রুত এবং ধীর গতির ডিসরাপশন

আরিফুল ভূঁইয়া
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি
প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:০৪
আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:০৪

(প্রিয়.কম) উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্রযুক্তিগত উন্নতির সীমানাকে প্রতিনিয়ত ঠেলে উপরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আর তাই, উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তিগত উন্নতির গ্রাফটা চোখ ধাঁধানোর মতোই। যে কোনো দেশের প্রযুক্তিগত উন্নতি আবার দুটি ভিন্ন পথে চলমান থাকে। এক. অনুভূমিক উন্নতি এবং দুই. উলম্ব উন্নতি। অনুভূমিক উন্নতি বলতে মূলত কপি আর পেস্ট করে কোনো দেশের উন্নতিকে বুঝানো হয়। ধরুন, দেশ A নতুন কোনো প্রযুক্তি নির্ভর প্রোডাক্ট অথবা প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসলো। আসার পর পরই অন্য কোনো দেশ B সেটাকে নকল করে হুবুহু সেই প্রোডাক্ট বানিয়ে সেই নকল প্রোডাক্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়ে মুনাফা অর্জন করা শুরু করে দিল। আর তাতে দেশ B এর জিডিপিতে লক্ষণীয় উন্নতি পরিলক্ষিত হলো। তখনই দেশ B এর অনুভূমিক উন্নতি হচ্ছে বলে ধরা হয়। ম্যাক্রো লেবেলে এই অনুভূমিক উন্নতিকে গ্লোবালাইজেশনও বলা হয়। চীনকে এই গ্লোবালাইজেশনের গুরু বিবেচনা করা হয়। পাশ্চাত্য দেশের যে কোনো নতুন প্রযুক্তি অথবা প্রোডাক্টকে কপি আর পেস্ট করতে চীনের আগে অন্য কোনো দেশ করতে পারে কিনা আমার জানা নাই। আবার এও সত্যি, এই মুহূর্তে চীনের মেধাবী, জ্ঞানী এবং পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী যে একেবারে কপি আর পেস্টের ওপর নির্ভরশীল সেটা বলা অন্যায় হবে।

অন্যদিকে নতুন কিছু করে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারলেই সেই নতুন কিছু করাকেই উলম্ব উন্নতি বলা হয়। এই চরম প্রতিযোগিতার যুগে পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলো একে একে নতু্ন নতুন আইডিয়াগুলোকে সফল ফিজিক্যাল সত্তায় পরিণত করাতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। উলম্ব উন্নতিতে ‘নতুন’ শব্দটা বুঝাতে ইংরেজিতে কখনও ইনোভেশন (innovation) আবার কখনও আবার ডিসরাপশন (disruption) ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইনোভেশন (innovation) এবং ডিসরাপশন (disruption) শব্দ দুটিই বাংলা শব্দ ‘নতুন’ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও ইনোভেশন (innovation) দিয়ে এক ধরনের নতুন এবং ডিসরাপশন (disruption) দিয়ে আরেক ধরনের নতুনকে বুঝায়। তার মানে সব নতুনই একই ধরনের নতুন না। এবার দেখে নেই সেই দুই ধরনের নতুনকে। মানুষ কখনো প্রকৃতির সঙ্গে আবার কখনো বা নিজেদের সঙ্গে লড়াই করে প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে টিকে ছিল তরবারি দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় মানুষের হাতে উঠে আসে ব্রোঞ্জের তৈরি তরবারি। ব্রোঞ্জের তৈরি তরবারি খুবই ধারালো হয়। কিন্তু ব্রোঞ্জ খুব বেশি শক্তিশালী না হওয়াতে, তরবারিগুলো হতো ছোট আকারের। তারপর বাজারে আসতে থাকে লৌহভিত্তিক এলয়। লৌহভিত্তিক এলয় শক্তির বিবেচনায় ব্রোঞ্জ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হবার কারণে বড় আকারের তরবারি বানানোর ট্রেন্ড শুরু হয়। আর ধীরে ধীরে লৌহনির্ভর এলয় দিয়ে তৈরি তরবারি হয়ে উঠল বিভিন্ন জাতি, গোত্রের স্বাধীনতা আর শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রতীক। সেই তরবারিকে আরও কত শক্তিশালী করা যায় আর তাতে যুদ্ধে কীভাবে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা যায়, সেটার জন্য একে একে বাজারে আসতে থাকল নতুন নতুন লৌহনির্ভর বিভিন্ন এলয়। আর এই চলমান প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন উন্নতিকেই ইনোভেশন (innovation) বলা হয়। এখানে তরবারি তারবারির জায়গায় আছে, শুধু ইনঅ্যাকটিভ (innovative) ওয়ে তৈরি করা লৌহভিত্তিক এলয়গুলো তরবারিকে নিয়ে গিয়েছিল এক নতুন উচ্চতায়।

এবার দেখে নেই আরেক ধরনের নতুনকে। রাইডারস অফ দ্যা লষ্ট আর্ক (Raiders of the Lost Ark) মুভিটার কথা মনে আছে সবার নিশ্চয়। যখন এক আরব তার তরবারি দিয়ে ইন্ডিয়ানা জোন্সকে অনেক কারসাজি দেখিয়ে যাচ্ছিল, তখন ইন্ডিয়ানা জোন্স আস্তে করে পিস্তল বের করে আরব ভদ্রলোককে গুলি করে খেলা শেষ করে দিল। বিভিন্ন জাতি, গোত্রের স্বাধীনতা আর শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে তরবারি যখন একচেটিয়া দাপট খাঁটিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই একটা পিস্তল আর একটা গুলিই তরবারির সমস্ত খবরদারিকে মুহূর্তেই মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসলো। মুহূর্তেই পিস্তল দখল করে নিল তরবারির জায়গাটা। আর এটাকেই ডিসরাপশন (disruption) বলা হয়। অর্থাৎ নতুন একটা প্রযুক্তি অথবা প্রযুক্তি নির্ভর প্রোডাক্ট বিদ্যমান অন্য কোনো প্রযুক্তি অথবা প্রযুক্তি নির্ভর প্রোডাক্টকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত করতে পারে তখন সেই নতুন পরিবর্তনটাকেই ডিসরাপশন (disruption) বলা হবে। আবার এই ডিসরাপশন (disruption) খুব দ্রুতও হতে পারে আবার খুব ধীরে ধীরেও হতে পারে। তরবারির এই উদাহরণটা খুব দ্রুত ডিসরাপশন (disruption) হবার একটি উদাহরণ।

এবার ধীরে ধীরে ‍ডিসরাপশন (disruption) হবার একটি উদাহরণ দেই। ১৮৯৪ সালে প্যারিসে প্রায় ১০২ জন এন্ট্রেন্টস ‘প্যারিস-রুইন রেইস’ নামক এক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। স্টিম, গ্যাসোলিন, ব্যাটারি, কম্প্রেসড বায়ু এবং হাইড্রলিক উৎস থেকে উৎপাদিত শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রুপান্তর করে ঘোড়াবিহীন কেরিয়াজ চালানো হয়েছিল। ১২৬ কিমি. (৭৮ মেইল) অতিক্রম করার সামর্থের ওপর ভিত্তি করেই মাত্র ২১ এন্ট্রেন্টস শীর্ষ তালিকায় অবস্থান দখল করতে পারে। এর মধ্যে সবার উপরে ছিল গ্যাসোলিন চালিত ইঞ্জিনগুলো। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত গ্যাসোলিন চালিত ইঞ্জিনগুলো আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর রাস্তা ঘাটে। সেইদিন গ্যাসোলিন চালিত ইঞ্জিনগুলোর শক্তির সঙ্গে ব্যাটারি কোনোভাবে প্রতিযোগিতাই টিকে থাকতে পারেনি। সেই সময় ৩০ কি.মি. যাবার পরই ব্যাটারি চালিত কেরিয়াজগুলোকে থামতে হতো ব্যাটারি পরিবর্তনের জন্য। সেই থেকে প্রায় ১২১-১২২ বছর পর এখন টেসলা মডেল এস ব্র্যান্ড ব্যাটারি চালিত গাড়ি একবার চার্জ নিয়ে প্রায় ১ হাজার কি.মি. চলে যায়। এখন ব্যাটারি চালিত গাড়িগুলোই গ্যাসোলিন চালিত গাড়িগুলোর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করেছে। তবে প্রতি ইউনিট শক্তি উৎপাদনে ব্যাটারির খরচ অনেক বেশি হলেও, আশা করা যাচ্ছে এর খরচ দশ ভাগের এক ভাগে নিয়ে আসবে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে। সঙ্গে শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা ও বেড়ে যাবে চারগুণ। ২০২২ সালের মধ্যেই ব্যাটারিচালিত গাড়িগুলো গ্লোবাল গাড়ি বিক্রয়ের ১৪ শতাংশ দখল করে নেবে, আর এটা এক সময় ১০০ ভাগ হয়ে যাবে; পৃথিবী সেই পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক দশক ধরে ইনোভেটিভ (innovative) উপায়ে ব্যাটারির কার্যক্ষমতা শুধু বেড়েই যাচ্ছে। যেই মুহূর্তে ব্যাটারি চালিত যানবাহনগুলো গ্যাসোলিন ইঞ্জিন চালিত যানবাহানগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে ঠিক তখনই ব্যাটারিকে দিয়ে ‍ডিসরাপশন (disruption) হয়েছে বলে মনে করা যাবে। তবে সেটা হবে খুব ধীর গতির ডিসরাপশন (disruption).

এবার আসি আমরা আমাদের জীবনকে কীভাবে ডিসরাপশন (disruption)-এর আওতায় আনতে পারি। জিম কলিন্স তার ‘গুড টু গ্রেট’ (Good to Great) বইটা শুরু করে ছিলেন ‘গুড টু দ্য এ্যানিমি অফ গ্রেট’ (Good is the enemy of great) দিয়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু থতমত খেয়ে যাবার কথা। ভালো তো ভালোই। ভালো আবার শত্রু হয় কীভাবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা যখন অনেক পরিশ্রম করে একটা ভালো অবস্থানে আসি, তারপর হঠাৎ করে অনেক সময় সেই লেভেলে আমার আটকে যাই। সেখান থেকে বের হয়ে পরের লেভেলে যাওয়াটা আমাদের অনেকের জন্যই অনেক কঠিন হয়ে যায়। আর তাই আমরা আর সেই লেভেলটা পার হবার চেষ্টা ছেড়ে দেই। মনে মনে ভাবি ভালোই তো আছি। আর কী দরকার? আর তখনই আমাদের ভালো অবস্থানটাই আমাদের পরবর্তী পর্যায়ের যাবার পথে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভালো এক অবস্থান থেকে পরবর্তী অবস্থান পৌঁছাতে হলে খুব বড় ধরনের এক ইনপুট দিতে হয়— বিশাল এক দেয়ালকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে সম্পূর্ণভাবে নতুন কিছুকে নিয়ে আসতে হয়। এটা শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই না- এটা পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই সত্যি। চলমান উন্নতির কথা আমরা প্রায় শুনি। চলমান উন্নতির চেষ্টাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ভালো একটা লেভেলে আমরা পৌঁছাতে পারি, কিন্ত গ্রেট হবার জন্য আরও বেশি কিছু করতে হবে, ভেঙে-চুরে নিয়ে আসতে হবে নতুন কোনো কিছুকে, নিয়ে আসতে হবে আমাদের জীবনে ডিসরাপশন (disruption)। 

[আমার পরবর্তী লেখা চলবে আমরা আমাদের নিজেদের জীবনকে কেন এবং কীভাবে বদলে দিতে পারি।]

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]