কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ছবি কৃতজ্ঞতা : ফারিয়া ইসলাম

‘কয়েকবার মনে হয়েছে চলে যাই সব ছেড়েছুড়ে’

কে এন দেয়া
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:০৪
আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:০৪

(প্রিয়.কম) বিদেশে চাকরির কথা ভাবতেই খুশি হয়ে ওঠেন অনেকে। একে তো নতুন একটি দেশ দেখা হবে, আবার উপার্জনটাও হবে বেশি-এমনটাই ভাবেন তারা। কিন্তু এ ব্যাপারটা শুনতে যতটা আকর্ষণীয় এবং লোভনীয় মনে হয়, বাস্তবে ততটাই কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। নারীদের জন্য তো আরো বেশি।

স্বজন-স্বদেশ থেকে দূরে বিদেশবিভুঁইয়ের মাটিতে একটু একটু করে নিজের জায়গা করে নেয়ার অভিজ্ঞতার কথাই প্রিয়.কমকে জানালেন ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট ফারিয়া ইসলাম। 

পুষ্টিবিদ হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে চাকরি করেছেন ফারিয়া ইসলাম। দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে সেটা আর হাতছাড়া করেননি। FK Norway-এর আওতায় নেপালের একটি হাসপাতালে তার চাকরি হয়ে যায়। কিন্তু চাকরির শুরুটায় ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। পরিবারের কেউ রাজি তো কেউ নারাজ। কেউ উৎসাহ যোগায় তো কেউ একা মেয়ে বিদেশ যাবে সেই দুশ্চিন্তায় আকুল। শেষ পর্যন্ত তিনি পাড়ি জমান ভিনদেশে।

বিদেশে যাবার অভিজ্ঞতা আগে থাকলেও নতুন একটি দেশে চাকরি নিয়ে ভয় এবং সংশয় ছিলই। কোথায় থাকবেন? কী খাবেন? কথা বলবেন কীভাবে? কোন সমস্যা হলে কাকে বলবেন? এসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মনে। 

ফারিয়া প্রথমে এসে নামলেন কাঠমান্ডুতে। দুদিন আশেপাশের জায়গা ঘুরে-ফিরে দেখেন। জানতে পারলেন পর্যটন এলাকা হওয়ার কারণে কিছু কিছু মানুষ হিন্দি বোঝে। মনে মনে ভাবলেন খুব একটা সমস্যা হবে না। 

তার কর্মস্থল কাঠমান্ডু থেকে বেশ দূরে, চিত্বান নামের একটি জায়গায়। পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাবার সময়ে ভারিয়া ভাবছিলেন, মানুষগুলো আমাকে আপন করে নেবে তো? আমি আবার একদম একা হয়ে যাব না তো? তার ভাবনা আর চারপাশের অপরূপ সৌন্দর্য মাঝে মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।

অফিসের গাড়ি এসে থামে ফারিয়ার হাসপাতালের সামনে। বাসাটাও তার কাছেই। বাড়িওয়ালার সাথে পরিচিত হবার সময়ে বুঝলেন, এই এলাকার মানুষ নেপালি ভাষা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তরুণেরা কিছুটা হিন্দি জানলেও বয়স্কদের সাথে কথা বলতে গেলে নেপালি শিখতেই হবে। হাসপাতালের রোগীদের সাথেও কথা বলতে হবে নেপালি ভাষাতেই। ফারিয়া বুঝলেন যত দ্রুত সম্ভব ভাষা আয়ত্তে আনতে হবে, নয়তো বিপদ সন্নিকটে।

চিত্বানের আবহাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হলো না ফারিয়ার। বরং বাংলাদেশের মতোই বেশ গরম এলাকাটি। এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যাও বেশ প্রকট। 

হাসপাতাল

হাসপাতালে সময় পেলেই কর্মীদের সাথে কথা বলতেন ভাঙা ভাঙা নেপালিতে। ছবি : ফারিয়া ইসলাম 

হাসপাতালের প্রথম দিন কপালে লাল টিকা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। নেপালি ট্র্যাডিশন বলে এতে আপত্তি না করাই ভালো, ভাবলেন ফারিয়া। সবাই গড়্গড় করে নেপালি বলছেন আর তিনি হাসিমুখে মাথা নেড়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালে রোগীর সাথে কথা বলার জন্য একজন নার্স দেয়া হলো, যিনি হিন্দি থেকে নেপালি ট্রান্সলেট করে দেবেন। তাই কিছু সময়ের জন্য স্বস্তি পান ফারিয়া। 

প্রথম প্রথম খাবার নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েন ফারিয়া।  কাঠমান্ডুতে রেস্টুরেন্টের খাবার তেমন খারাপ ছিল না, ভাত পাওয়া যায় সবখানেই। তবে এখানে হালাল খাবার পাওয়া নিয়ে সমস্যা, আর মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে। তাই শুরুর দিনগুলো সবজি, ডিম আর দুধ দিয়ে পার করেন। তবে একটা ভালো ব্যাপার হলো, দাম অনেকটাই কম। আরেকটা সমস্যা হলো, কোন খাবারের কী নাম, সেটা তার জানা নেই। তাই ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে খাবারের নাম টুকে রাখতেন। প্রথম প্রথম ভর্তা আর ডাল-ভাত দিয়ে চলতে হয়। এরপর ইউটিউব দেখে দেখে কিছু রান্না শিখতে লাগলেন। 

সময়ের সাথে সাথে আরো কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ফারিয়াকে। রাস্তাঘাট কিছুই চিনতেন না তিনি। স্থানীয় কারো সাহায্য ছাড়া নতুন কোথাও যাওয়া যায় না। আর তার সাথে কারো এত ভালো পরিচয় নেই যে সাহায্য করবে। তাই বাজার করা, আশপাশের এলাকায় যাওয়া, কোথায় কী আছে চেনা-এসবের জন্য প্রথম দিকে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। 

একা একা বাসায় থাকা নিয়েও প্রচণ্ড মন খারাপ হতো ফারিয়ার। পরিবারের সবাইকে মিস করতেন। এ প্রসঙ্গে ফারিয়া বলেন, ‘কয়েকবার মনে হয়েছে চলে যাই সব ছেড়েছুড়ে।’ কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হতো, এত সহজে হাল ছাড়া যাবে না, এই ভেবে আবার কাজে মন বসাতেন।

তিহার

তিহার উৎসবে স্থানীয় নেপালিদের সাথে। ছবি : ফারিয়া ইসলাম

একপর্যায়ে নেপালি ভাষা শেখা শুরু করেন ফারিয়া। এতে খুব দ্রুতই সহজ হয়ে আসে জীবন। যদিও ভাষা শিক্ষা ক্লাস বেশ দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল তার। কিন্তু দৃঢ়সংকল্প তাতে বাদ সাধতে পারেনি। হাসপাতালে সময় পেলেই কর্মীদের সাথে কথা বলতেন ভাঙা ভাঙা নেপালিতে, রোগীদেরকে উপদেশও দেন সে ভাষায়। তার আন্তরিকতায় দিনে দিনে সবাই মুগ্ধ হতে থাকে। তাই হাসপাতালের সবাই খুব সহজেই তাকে আপন করে নেয়। নানাভাবে তাকে সাহায্য করতে শুরু করে। নেপাল আসলে মেয়েদের জন্য অনেক নিরাপদ-এটা বোঝার পর অবশ্য তেমন কোনো সাহায্য ছাড়াই একা একা চলাফেরা করতে থাকেন ফারিয়া। 

নেপালে মানুষের খাওয়ার ধরন আমাদের থেকে আলাদা। তারা দিনে দুই বেলা ভারী খাবার খায়-সকাল এবং সন্ধ্যায়। দুপুরে কেউ কেউ নাশতা খায়, বেশিরভাগই খায় না। সন্ধ্যারাতের মাঝেই শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। পুষ্টিবিদ হিসেবে ফারিয়া যখন তাদের দিনে ৪-৫ বার খাওয়ার উপদেশ দেন, তারা হেসেই উড়িয়ে দেয়। এর পাশাপাশি অ্যালকোহল খুব সহজলভ্য হওয়ার কারণে অনেকেরই লিভারের সমস্যা দেখা দেয়। ফারিয়া ব্যাপারটি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন।

এভাবেই একে একে কেটে যায় পাঁচটি মাস। ফারিয়া ইসলাম ভেবে দেখেন, দেশে কাজগুলো করা অনেক সহজ ছিল, রোগীদের সাথে নিজের ভাষায় কথা বলার ব্যাপারটাই আলাদা। নিজের মতো করে তাদের বোঝানো যেত, সেই সাথে যোগ হতো আবেগ। কিন্তু নেপালে ভাষাগত বাধার কারণে সে আবেগ হয়ে পড়ে মূক।

ভাষার কারণে পুষ্টিবিদ হিসেবে কাজে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে নেপালের চাকরি জীবন খুবই উপভোগ করছেন ফারিয়া ইসলাম। হাসপাতালের কর্মীদের কাছে তিনি এখন প্রিয়মুখ। আর নেপাল হলো অনুষ্ঠানের দেশ, তাই সব সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ভালো সময় কাটানোর চেষ্টা করেন তিনি।

সব মিলিয়ে প্রবাসী জীবনকে এখন ভালোই লাগে পুষ্টিবিদ ফারিয়া ইসলামের। এখন আর নেই প্রথম দিকের বিষন্নতা।

প্রিয় লাইফ/আরবি/আজাদ চৌধুরী