কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভগবত। ছবি : সংগৃহীত

পশ্চিমবঙ্গে বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে গেলেন ভগবত

গৌতম রায়
অধ্যাপক, গবেষক
প্রকাশিত: ০১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:০৯
আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:০৯

রাজ্যওয়ারি সফরে ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে গেলেন আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) প্রধান মোহন ভগবত। ত্রিপুরায় যেহেতু বিধানসভার ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে, তাই গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরই অনেকদিন ধরে ওই রাজ্যটিকে প্রায় পাখির চোখ করে রেখেছে। মুকুল রায় তৃণমূলে থাকাকালীন কংগ্রেসের থেকে কিছু বিধায়ক ভাঙিয়ে তাঁদের তিনি ভিড়িয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে। মুকুলবাবুর সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সময় থেকেই সেই সব বিধায়করা ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকেন বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে। নেপথ্যে থাকে বিজেপির মূল চালিকা শক্তি আরএসএস। এই পরিস্থিতির ভিতরেই রাজ্যওয়ারি সফরে প্রথমে ত্রিপুরা এবং পরে পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে গেলেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভগবত।

ত্রিপুরা সফর সেরে কয়েকদিনের জন্যে এ রাজ্যে এসেছিলেন মোহন ভগবত। গত সাড়ে ছয় বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস এবং তাদের বিভিন্ন প্রকারের শাখা সংগঠনগুলির যে বিস্তার ঘটেছে তাতে যে সরসঙ্ঘপ্রধানসহ সঙ্ঘের প্রথম সারির নেতারা বেশ খুশি, সেটা তাঁদের নানা সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ভিতরে অনেকদিন ধরেই উঠে আসছে। সাংগঠনিক বিস্তারের পাশাপাশি গত ছয় বছরে নিজেদের অনুকূলে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বভাবসুলভ যে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং আরএসএস এই রাজ্যে চালিয়ে আসছে তার পর্যালোচনা ছিল মোহন ভগবতের সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আরএসএস নিজেরা সরাসরি এবং তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কে এ রাজ্যে সামাজিক স্তরে কতোটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছে তার বিচার বিশ্লেষণের জন্যেই নিজের সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ সফরের সিংহভাগ খরচ করেছেন মোহন ভগবত। যে ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির এ রাজ্যের মানুষদের সামাজিক জীবনে ভালো গ্রহণযোগ্যতা আছে, সেগুলিকে নিজেদের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মসূচির ভিতরে আরএসএস অনেক দিন ধরেই নিয়েছে। আরএসএসের সামাজিক প্রযুক্তির এই দিকটি কিন্তু তাঁদের ‘স্বাভাবিক মিত্র’, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও অনেকখানিই অনুসরণ করে চলছে।

মোহন ভগবত তাঁর পশ্চিমবঙ্গ সফরে যতটা সঙ্ঘ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সময় কাটিয়েছেন, তার থেকে বেশি সময় তিনি খরচ করেছেন এ রাজ্যে তৃণমূলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁদের অনুকূলে সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে যেসব মানুষদের তারা সঙ্ঘের তথাকথিত দর্শনের কাছাকাছি আনতে পেরেছেন, সেই সব মানুষদের সঙ্গে। সঙ্ঘের মতো তথাকথিত শৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ না ঘটাতে পারলেও তৃণমূল কিন্তু তাঁদের মতো করে এক ধরণের সামাজিক প্রযুক্তি যে ঘটায় - সেই বাস্তবতাকে কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করা যায় না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে এ রাজ্যে যে নিচ্ছিন্দ্র নিরাপত্তায় সঙ্ঘ পরিমন্ডলের শিক্ষালয়গুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে তেমনটা অতীতে পশ্চিমবঙ্গে কোনোদিন হয়নি। সঙ্ঘ পরিমন্ডলের এইসব স্কুলগুলির প্রচলনের ক্ষেত্রে আরএসএস ও গত কয়েক বছরে তাঁদের অতীতের অভ্যাস থেকে বেশ কিছুটা সরে এসেছে। বাজপেয়ী জমানাতে সঙ্ঘের নিজস্ব ঘরানার স্কুলের ক্ষেত্রে ‘সরস্বতী শিশু মন্দির’ জাতীয় নামকরণটা ছিল একপ্রকার বাধ্যতামূলক। আরএসএস এখন কেবলমাত্র এই রাজ্যেই নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী প্রসূত স্কুল তৈরির ক্ষেত্রে নামকরণের বিষয়ে অতীতের রক্ষণশীল অবস্থান আর নেয় না। এটাও অবশ্যই তাঁদের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সময়ের প্রেক্ষিতে কৌশলগত একটা পদক্ষেপ।

অতীতে তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীর স্কুল ইত্যাদি পরিচালনার ক্ষেত্রে যে ধরণের ধারাবাহিকতাযুক্ত নাম ব্যবহার করতো তাতে ধীরে ধীরে ওই ধরণের স্কুলগুলির পিছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে যে সরাসরি আরএসএস রয়েছে, সেটা ক্রমশঃ সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছিল। এই কারণে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে আরএসএস তাঁদের স্কুলগুলিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু কৌশলগত অদলবদল আনে। এই কৌশলগত অদলবদলের প্রাথমিক বিষয়টি ই হলো; অতীতের নামকরণ থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরে আসা। যাতে সাধারণ মানুষের কাছে এইসব স্কুলগুলির পিছনে আরএসএসের ভূমিকা সহজে না প্রকাশ পায়।

এই কৌশলগত কারণে আরএসএস গত বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এ রাজ্যে বিবেকানন্দ, সারদামণি প্রমুখ এই রাজ্যে জনপ্রিয় এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মণীষীদের নামই বেশি রকম ভাবে ব্যবহার করছে। এই ধরণের নাম ব্যবহারের ফলে যে কারণে খুব সহজে সকলের কাজে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আড়ালে আসল কারসাজি যে স্বয়ং আরএসএসের রয়েছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ই ধরা পড়ছে না। আর এই কৌশল দিয়েই আরএসএস তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে এ রাজ্যে ক্রমশঃ একটা বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেলে ধরতে চাইছে। রামকৃষ্ণ মিশনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনো কোনো সন্ন্যাসী পৃথক ভাবে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন । আবার ওই ধরণের কিছু মানুষ এমন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যাঁদের নামের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দ প্রমুখ মণীষীদের সংযোগ আছে।

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পরিমন্ডলের বাইরের ওই ধরণের কিছু মানুষ, যাঁরা একদিন মিশনের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদেরকে আরএসএস নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে খুব বেশি ভাবে যুক্ত করছে। এই ধরণের সংযোগের ফলে রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যে সুনাম রয়েছে , সেটাতে যাতে তাঁদের পরিচালিত স্কুলগুলিও ভাগিদার হতে পারে-সেই সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং প্রসারে আরএসএস এখন এ রাজ্যে খুব বেশি তৎপর হয়ে পড়েছে। তবে মহারাষ্ট্রে আরএসএস এখন যেসব নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, সেগুলির নাম করণের ক্ষেত্রে তাঁদের বর্তমান কৌশলের অঙ্গ হিসেবে সেখানকার সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত জ্যোতিবা ফুলের নাম ব্যবহার করতে ও দ্বিধা করছে না।

আরএসএস পরিচালিত স্কুলগুলির ভিতর দিয়ে সঙ্ঘের আত্মঘাতী দর্শন শিশুমণে গেঁথে দেওয়ার যে সামাজিক প্রযুক্তির কৌশল হিন্দুত্ববাদীরা নিয়েছে তা রাজ্য সরকারের পাশ - ফেল প্রথা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে একটা নতুন আঙ্গিক পেয়েছে। তাই মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে এই বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল সঙ্ঘের আভ্যন্তরীণ পরিমন্ডলে। পাশ-ফেল প্রথার পুনর্বহাল ঘটলে গ্রামাঞ্চলে একটা বড়ো অংশের স্কুল ছুট ঘটবে- এটা অনুমান করে সেই স্কুল ছুট অংশের দিকে লক্ষ্য নজর এখন থেকে রাখার জন্যে সঙ্ঘের প্রাদেশিক নেতারা মোহন ভগবতের উপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। ড্রপ আউটের ফলে সবথেকে বেশি প্রভাব পড়বে দলিত, মেয়েরা এবং সংখ্যালঘুদের উপর। সংখ্যালঘু দের নিয়ে আরএসএসের কোনো চিন্তা নেই। দলিত এবং মেয়েদের ভিতর যে অংশটি পাশ- ফেল প্রথা ফিরে এলে আর স্কুলমুখী হবে না, তাঁদের এখন থেকেই চিহ্নিত করে, তাঁরা যাতে আরএসএস পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতরে চলে আসতে পারে সেজন্যে মোহন ভগবতের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরের সময়ে সঙ্ঘ কর্মীদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই উদ্যোগকে সফল করতে আরএসএসীয় আঙ্গিকে নানা সামাজিক কর্মকান্ড পশ্চিমবঙ্গ সফর কালে পালন করে গেলেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ রশিদ খানের বাড়িতে যান। তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পিছনে মোহন ভগবতের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল; নিজের একটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংস্কৃতি মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা। এভাবে তিনি বাঙালি সমাজের শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, অভিজাতদের ভিতরে নিজের একটা গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরবার চেষ্টা করলেন। মোহন ভগবত শিল্পীর বাড়িতে যাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তাঁর সামাজিক প্রযুক্তি প্রকল্পের সাথী সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ দেখালেন, ভগবত কতো সঙ্গীতমোদি। তিনি নাকি ওস্তাদ রশিদ খানকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কয়েক কলি গেয়ে মুগ্ধ করেছেন- এমন সব খবর দিতেও ভগবতের গুণমুগ্ধ একটি অংশের কাগজ নিউজ প্রিন্টের কার্পণ্য করলো না। সেইসব খবরের কাগজগুলো আবার এটাও জানালো যে, মোহন ভগবত নাকি তাঁর নিজের লেখা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উপর গ্রন্থাবলী ওস্তাদ রশিদ খানকে উপহার দিয়েছেন। এভাবেই নরহত্যায় ইন্ধন দেওয়া ভগবত, মুসলমানদের ভাতে এবং জানে মারার নোংরা ষড়যন্ত্রকারী ভগবতকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিতে সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ তাঁর পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে প্রায় আত্মনিবেদন করে দিলো। এটাই হচ্ছে আরএসএসের এ রাজ্যে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি উল্লেখযোগ্য গতি প্রকৃতি।

মোহন ভগবত তাঁর পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান কালে এ রাজ্যের বেশ কিছু প্রথম সারির শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আরএসএস বা তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কিংবা তাঁদের হরেক রকমের শাখা সংগঠনগুলি নিজেদের সাবেক মধ্যসত্ত্বভোগী ট্রেডার্সদের প্রতিনিধির তকমাটা বেশ কিছুকাল ধরে যত্ন করে তুলে ফেলতে চেষ্টা করছে। তাই আরএসএস বা তাদের সাবেক রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা বা ভারতীয় জনসঙ্গ বা আজকের বিজেপির পিছনে যে মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়ে সম্প্রদায়ের গভীর সহানুভূতি ছিল, সেটাকে অনেকদিন ধরেই অতিক্রম করতে বিশেষ রকমের তৎপর। বাজপেয়ীর তিনদফায় সাড়ে ছয় বছরের শাসনকালের পরে এখন অবশ্য আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কেবলমাত্র বড়বাজারের ট্রেডার্সদের স্বার্থ রক্ষাকারী রাজনৈতিক দল বলা যায় না। দেশের বৃহৎ বুর্জোয়াদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন রীতিমতো আস্থা রাখে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির উপর।

তাই মোহন ভগবতের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরের সময়ে তাঁর সঙ্গে শিল্পপতিদের যে বৈঠক হলো, সেখানে তাঁদের সাবেক বন্ধু বড়বাজারের ট্রেডার্সদের থেকে বড়ো বড়ো শিল্পপতিদেরই সব থেকে বেশি দেখতে পাওয়া গেছে। বাজপেয়ী জমানার আগে পর্যন্ত বড়বাজারের মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়ে ব্যবসায়ীদের যে অংশ টা সবথেকে বেশি পরিমাণে আরএসএস- বিজেপির সভায় ভিড় জমাতেন, সম্প্রতি মোহন ভগবতের সঙ্গে কলকাতাতে শিল্পপতিদের বৈঠকে সেই অংশের মানুষদেরই অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে সেই অংশ টিকে সঙ্ঘ তাঁদের শাখা সংগঠন ‘স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ’ এর মাধ্যমে কিন্তু যথারীতি নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে জোরদার ভাবেই ব্যবহার করে চলেছে। যদিও এই অংশের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা পশ্চিমবঙ্গ সফর কালে কেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভগবত কার্যত এড়িয়ে গেলেন- তা রীতিমতো সন্দেহের উদ্রেক করে।

মোহন ভগবত তাঁর রাজ্যওয়ারি সফরের অংশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে যে বিভাজনের বিষ ছড়ালেন, সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কলা কৌশলকে যে শক্তি জোগালেন সেখানে আর একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো এ রাজ্যের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির আর্থ- সামাজিক- রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে লেখক- শিল্পী- শিক্ষক- অধ্যাপকদের যে অংশটি গভীর ভাবে সম্পৃক্ত, তাঁদের সঙ্গে কিন্তু কৌশলগত কারণেই তিনি নিজে কোনো একান্ত আলাপচারিতায় বসলেন না। মোহন ভগবত কলকাতায় থাকাকালীনই হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এই বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বসলেন আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা শিবপ্রসাদ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী দেখা গেছে আপাতভাবে নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবি করা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা সৈয়দ তনভীর নাসরিন ও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন (এই সময়,২২\১২\১৭।পৃষ্ঠা-৯)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রগতিশীল সাহিত্যিক দেবেশ রায় সম্পাদিত একটি সাহিত্য পত্রিকাতে সংশ্লিষ্ট বিজেপিপন্থী বুদ্ধিজীবী একজন বিশেষ পদাধিকারী। এটাই হলো আরএসএসের এ রাজ্যে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পায়ের তলায় জমি তৈরি করে দেওয়ার জন্যে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কৌশল।

এই সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কৌশলের অঙ্গ হিশেবেই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতরে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভগবত ছুটে যান রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষের কাছে। আর সঙ্ঘের সেই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির অনুকূলে পরিবেশ রচনার জন্যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ তৈরি করে দেয় এই রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। অনেকদিন আগে এক বৈদ্যুতিক মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরএসএস- বিজেপিকে তাঁদের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মমতার সাড়ে ছ বছরের শাসনকালে এই স্বাভাবিক মিত্রের অবাধ গতিবিধির অনুকূলে পরিবেশ রচনার জন্যে মমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা যে কতোখানি আন্তরিক তার আর একবার প্রমাণ আমরা পেলাম রাজ্য বিধানসভার বার্ষিক পুষ্প প্রদর্শনীতে। সেখানে অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে গীতা পাঠ করা হলো। একটি সরকারী অনুষ্ঠানে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বিশেষ এক ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ আদৌ রাষ্ট্রের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয়। তবুও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটা করলেন। একাধারে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মুখে সংখ্যালঘুর উন্নয়নের কথা বলেন।

কার্যক্ষেত্রে অবশ্য সংখ্যালঘুর আর্থ- সামাজিক উন্নতি হবে - এমন একটি পদক্ষেপও তিনি নেন না। অথচ সংখ্যালঘুদের পক্ষে এমন কথা অভিনয়ের ঢঙে বলেন যা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে চরম উস্কানি দেয়। সরকারী অনুষ্ঠানে এই গীতা পাঠও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দেওয়ারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলা সভাপতি সেই জেলায় একটি ব্রাহ্মণ সন্মেলনের আয়োজন করতে চলেছেন, যা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে আরো কয়কগুণ যে বাড়িয়ে দেবে- সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মোহন ভগবত তাঁর পশ্চিমবঙ্গ সফরে ধর্মীয় এবং সামাজিক মেরুকরণের যে বিষ ছড়িয়ে গেলেন, তাকে সমাজের ভূমিস্তরে সংক্রমিত করতে আরএসএসের স্বাভাবিক মিত্র তথা এ রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই যে ‘আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান, তারি লাগি কাড়াকাড়ি’ শুরু করে দিয়েছেন, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।

গৌতম রায়: প্রাবন্ধিক। পেশায় অধ্যাপক, গবেষক। দীর্ঘদিন অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]