কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

পেছনে জ্বলছে ফেলে আসা ঘরবাড়ি, প্রাণ বাঁচাতে সামনে বাংলাদেশই গন্তব্য। ছবি: ফোকাস বাংলা

যে কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াচ্ছে না বাংলাদেশ

আবু আজাদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:০৪
আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:০৪

(প্রিয়.কম) রাষ্ট্রীয় মদদে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শুরু করা ভয়ংকর ‘রোহিঙ্গা নিধন’ অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী। নৃশংস এ অভিযান চলাকালে দেশটির ড্রোন ও হেলিকপ্টার দফায় দফায় বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ঘটনার তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু কানে তোলেনি মিয়ানমার, তাদের ঔদ্বত্যপূর্ণ আচরণ অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনাকে সামরিক উসকানি হিসেবেই বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।

সেনা অভিযানে রোহিঙ্গাদের ঠেলে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া এবং আকাশসীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে অব্যাহত উস্কানি দেওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের যুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দাবিও করেছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদও পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধের পথে না গিয়ে বিষয়টি কৌশলে মোকাবেলা করছে। মিয়ানমার বাংলাদেশকে ভয়াবহ দুর্যাগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া ও বারবার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করলেও বাংলাদেশ কেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবে না, এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দাবি অবশ্য নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। যুদ্ধ বাংলাদেশের উন্নয়নকে ধ্বংস করবে।

আর বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা থেকে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতেই মিয়ানমার সামরিক উসকানি দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশকে সেই উসকানির ফাঁদ এড়িয়ে চলতে হবে। কূটনৈতিকভাবেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।

শরণার্থীর ঢল ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন

গত ১১ আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েনের পর  ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ‘জাতিগত নিধন’ শুরু করে। ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী। পুরনো পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার সাথে নতুন অভিযানে ইতোমধ্যে যোগ হয়েছে আরো পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সারা বিশ্বে ইউএনএইচসিআর কতৃক নিবন্ধিত ১৭.২ মিলিয়ন শরণার্থীর ৩০% এখন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে চলমান রোহিঙ্গা ঢল অব্যাহত থাকলে শরণার্থীর এ সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছে পারে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও দারিদ্র এবং বেকারত্বের দেশে নতুন করে আরো দশ লাখ শরনার্থী বহন করা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদজনক যা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।

সেনা প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা গ্রামে। তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে কয়েকজর স্থানীয় বৌদ্ধ। ছবি: সংগৃহীত

সেনা প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা গ্রামে। তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে কয়েকজন স্থানীয়রা। ছবি: সংগৃহীত 

এদিকে শরণার্থীর চাপ কমাতে রোহিঙ্গা দমন-পীড়ন অভিযান সীমিত করতে মিয়ানমারকে বার বার আহবান জানাচ্ছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অভিযান বন্ধ করা আহবান জানিয়েছে। তবু থামার কোনো লক্ষণ নেই দেশটির মধ্যে, বরং সামরিক উস্কানি দিতেই বার বার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। 

গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট সামরিক অভিযান শুরুর পরা থেকে মিয়ানমারের সামরিক ড্রোন ও হেলিকপ্টার কমপক্ষে ২০ বার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত দুই দফায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করেছে। ঢাকায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জ্য তে এ সময় বলেছেন, বিষয়টা তিনি তার দেশকে জানাবেন। তারপর সেখান থেকে তথ্য নিয়ে বাংলাদেশকে জানাবেন।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়ে মিয়ানমারকে সতর্ক করে দিয়ে এক বিবৃতিতে বলছে, ‘বার বার এ ধরনের উস্কানিমূলক কাজের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা। একইসঙ্গে এ ধরনের সার্বভৌমত্বের লংঘন যাতে আর না ঘটে তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, এ ধরনের উসকানিমূলক কাজের জন্য ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি’ দেখা দিতে পারে’।

রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই সামরিক উস্কানি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট থেকে বাংলাদেশ ও বিশ্বের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতেই বাংলাদেশকে সামরিক উস্কানি দিচ্ছে মিয়ানমার। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, মিয়ানমার চাইছে যেন সামরিক উত্তেজনা তৈরি হয়। এটা হলে রোহিঙ্গা সংকট থেকে দৃষ্টি সামরিক উত্তেজনার দিকে চলে যাবে। বাংলাদেশকে তাই সংযত আচরণ করতে হবে। কারণ সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি একটি কৌশল হতে পারে। ফলে এ মুহূর্তে ব্যাপারটা কূটনৈতিক প্রতিবাদে সীমিত রাখাই ঠিক হবে।

রোহিঙ্গা সংকট থেকে বিশ্ববাসীর নজর ভিন্ন দিকে সরাতে এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিতেই মিয়ানমার এমনটি করছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল আলম। প্রিয়.কমকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়ালেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি কূটনৈতিকভাবে সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সুযোগটিই হয়তো নিতে চাইছে দেশটি। 

পৃথিবীকে বুঝে ওঠার আগেই এসব শিশুরা যুদ্ধের নির্মমতার স্বীকার হয়ে দেশহারা। আশ্রয় মিলেছে গাছ তলায়। ছবিটি ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ফোকাস বাংলার তোলা।

পৃথিবীকে বুঝে ওঠার আগেই এসব শিশুরা যুদ্ধের নির্মমতার স্বীকার হয়ে দেশহারা। আশ্রয় মিলেছে গাছ তলায়। ছবিটি ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ফোকাস বাংলার তোলা।

কেন যুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কূটনৈতিক পথই সবচেয়ে ভাল উপায় মন্তব্য করে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিপস) প্রেসিডেন্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান বলেন, আমি এ মুহূর্তে সংঘাতে জড়ানো বা বলপ্রয়োগের পক্ষে না। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকটে কূটনৈতিকভাবে আমরা এখনও শক্ত অবস্থানে নেই। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া আমাদের বিপক্ষে আছে। তাই সার্বিক দিক চিন্তা করে কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।

‘মিয়ানমার বারবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে থাকলে প্রতিবাদের ভাষা আরও শক্ত করতে হবে। তারপরও সংঘাতে যাওয়া ঠিক না। এটা করা হলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না’, বলেন মুনিরুজ্জামান।

যুদ্ধের সম্ভাবনাকে একেবারেই নাকচ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম হুমায়ুন কবির প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা কেউই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নেই। যুদ্ধ কোনো সমাধান দেবে না। আমরা চাই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সম্মান দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাক। সেটি যুদ্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয়।’

গত বছরের অক্টোবরের সেনা অভিযানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন দিয়েছে বার্মিজ সৈন্যরা। ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের অক্টোবরেও সেনা অভিযানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গ্রামে আগুন দিয়েছিল বার্মিজ সৈন্যরা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি ও সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, দুটি দেশই উন্নয়নশীল দেশ। কোনো দেশই যুদ্ধের ব্যায়ভার বহন করার অবস্থায় নেই। যুদ্ধ হলে দুই দেশের অর্থনীতির ওপরই বিরূপ চাপ পড়বে। ভেঙে পড়বে উন্নয়ন। কাজেই যুদ্ধ পরিহার করে কূটনৈতিক সমাধানই সঠিক সিদ্ধান্ত।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক আফসান চৌধুরীও মনে করে যুদ্ধ ঘোষণা আত্মঘাতী হবে। প্রিয়.কমকে তিনি বলেন, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধে জড়ানো ঠিক হবে না। এতে অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব পড়বে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান হবে না। বরং রোহিঙ্গা সংকট আমাদের ওপর আরও চেপে বসবে। 

মিয়ামারের এত উস্কানি সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব ওয়ালিদ ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বুকে শক্ত যে অবস্থান করে নিয়েছে তা কিন্তু নিমিষেই হারিয়ে ফেলবে যদি মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়ায়। তাছাড়া যুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যুটির সমাধানও সম্ভব নয়। কাজেই সামরিক পদক্ষেপের মতো এতখানি অপরিপক্কতা দেখানো বাংলাদেশের উচিৎ হবে না।’

‘বরং সর্বোচ্চ দক্ষতা-প্রচেষ্টা এবং ধৈর্য্যের সাথে কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের সার্বভৌমত্ব ঠিক রেখে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে মিয়ানমারের উস্কানির ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না’, বলেন ওয়ালিদ ইসলাম।

প্রিয় সংবাদ/রিমন