কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

CHTexpress এর কর্ণধার অর্পণ চাকমা। ছবি: কে এন দেয়া

অকৃত্রিম পাহাড়ি স্বাদ নিয়ে শেফ অর্পন চাকমার বিশেষ আয়োজন!

কে এন দেয়া
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮, ১২:০২
আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮, ১২:০২

(প্রিয়.কম) রান্নাবান্না করতে যারা ভালোবাসেন, তাদের অনেকেই বেছে নেন শেফ বা রেস্টুরেন্ট ম্যানেজমেন্টের পেশাটি। তাদের মনোযোগ থাকে খুব আকর্ষণীয়, সুস্বাদু খাবার পরিবেশন। কিন্তু এটুকু করেই অনেকে থেমে যান, খাবারটাকে যে শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করা যেতে পারে, এর মাধ্যমেই উজ্জীবিত করা যেতে পারে দেশীয় সংস্কৃতি, তার দিকে খেয়াল দেন খুব কম মানুষ। এমন মানুষদের কাতারেই আছে অর্পণ চাকমা। নীল পাহাড়ের বুক থেকে তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন একদম খাঁটি, আদি ও অকৃত্রিম স্বাদ।

পাহাড়ি খাবারের প্রতি তার ভালোবাসার শুরু একেবারেই ছোটবেলা থেকে। মায়ের হাতের রান্না তো ভালোবাসি আমরা সবাই, কিন্তু তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মায়ের রান্না দেখতেন। তাকে রান্না শেখানোতে মায়েরও কোন আপত্তি ছিল না। কামাকুছড়া গ্রামের মুক্ত পরিবেশে এভাবেই একটু একটু করে পাকা রাঁধুনির পথ তৈরি হচ্ছিল। একটু বড় হবার পর বাড়ি থেকে অনেক দূরে এক মিশনারি স্কুলে পড়তে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে বাড়ির জন্য, বিশেষ করে পাহাড়ি রান্নাগুলোর জন্য ভীষণ কষ্ট হতো তার। অনেকদিন সময় লেগেছিল তার, অন্যরকম খাবারে অভ্যস্ত হতে।

গোরাম

বাঁশের ভেতর রান্নাটা পাহাড়ি খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ছবি: সিএইচটি এক্সপ্রেস

শেফ হবার যাত্রায় একটা সময়ে ভারতের সুভাস বোস ইন্সটিটিউট অফ হোটেল ম্যানেজমেন্টে কালিনারি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের এই সময়ের মাঝে তিনি পড়তে পড়তেই আবিষ্কার  করেন, তার সেই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামের খাদ্য সংস্কৃতিটা খুবই স্বাস্থ্যকর, খুবই সমৃদ্ধ। সেখানে এমন কিছু প্রণালী প্রয়োগ করা হয় যা কিনা শেখানো হচ্ছে পাঠ্যবইতেও। তখন থেকেই তার মনে ভাবনা থাকে, একসময় দেশীয় খাবার নিয়ে কিছু করবেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি খাবার নিয়ে গবেষণা কম করেননি অর্পণ। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছেন নিয়মিত। দেখেছেন কী বিচিত্র সব খাবার প্রচলিত এসব জায়গায়। কোথাকার খাবারে কেমন বৈশিষ্ট্য, কী উপকরণ জনপ্রিয়, সবই গুছিয়ে রাখেন মাথার ভেতরে। একটা সময় সিদ্ধান্ত নেন, মঙ্গোলয়েড কুইজিন নিয়েই কাজ করবেন তিনি।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করে তিনি ফিরে আসেন দেশে। এরপর ২০১৭ সালের জুন মাসে শুরু হয় সিএইচটি এক্সপ্রেস  (CHT Express) এর হোম ডেলিভারি। এ সময়ের মাঝে তিনি ঢাকায় খাবারের মার্কেট কেমন, তা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। অবাক হয়ে দেখেন, একেবারে অথেনটিক পাহাড়ি খাবার পাওয়া যায় না কোথাওই। পাহাড়ে ট্রেকিং করে যারা একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রামের খাবার খেয়ে এসেছেন, তারা ঢাকায় এসে এসব খাবারে মোটেই সেই স্বাদ পান না। অর্পণ তার বন্ধুদের থেকে এমনই ‘নালিশ’ পান কখনো কখনো। তাই তিনি একেবারেই সেই স্বাদ নিয়ে আসতে চান, যাতে চোখ বন্ধ করলে আপনার মনে হবে পাহাড়ি এলাকায় বসেই খাবার খাচ্ছেন।

Decor

ছিমছাম আরামদায়ক একটা আবহ পুরো জায়গাটায়। ছবি: কে এন দেয়া

পাহাড়ি খাবারের স্বাদ মোটেই এখনকার প্রচলিত রেস্টুরেন্টের খাবারের মত নয়, জানান অর্পণ। সবচাইতে বড় ব্যাপার হলো, পাহাড়ি খাবার খুব স্বাস্থ্যকর, আর তিনিও নিজের রেস্টুরেন্টে সেই ব্যাপারটাই রাখতে চান। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা থেকে শুরু করে ফুটানো পানি দিয়ে রান্না, একবার ব্যবহারের পর তেল আবার ব্যবহার না করে- এমন ছোট ছোট নিয়মগুলো তার হেঁশেলে মেনে চলা হয় শক্তভাবে।  সেই সাথে পাহাড়ি রেসিপিগুলো মেনে চলাও হয় খুব ভালো করে।

কাজীপাড়ায় সিএইচটি এক্সপ্রেস এর সদ্য চালু হওয়া রেস্টুরেন্ট বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে ছোট্ট এতটুকু। কিন্তু এর ভেতরে গেলেই মনে হবে আপনি আর ঢাকা শহরে নেই, নির্ঘাত সাজেক যাবার পথে কোন যাত্রাবিরতি ক্যাফেতে এসে পড়েছেন। ফার্নিচার থেকে আসছে কাঠের মিষ্টি সুবাস, দেয়াল জুড়ে আঁকা বিভিন্ন আদিবাসী বর্ণমালা, ফ্রেম করে টাঙানো হাতে বোনা কাপড়ের টুকরো, আর হালকা ল্যাম্পের আলোয় তৈরি হয়েছে জাদুকরি এক আবহ।

ভাবছেন, এ হয়তো আর দশটি ক্যাফের মতই। বসবেন, কিছু ফাস্টফুড জাতীয় খাবার খেয়ে চলে যাবেন? মোটেই না। প্রথমত মেনু দেখেই আপনার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে, কারণ খাবারের খরচ অসম্ভব কম। অর্পণ জানান, মাত্র ১৫০ টাকার মাঝে একজন মানুষ যাতে পেটপুরে খেয়ে নিতে পারেন তার ব্যবস্থা রেখেছেন তিনি। সবগুলো খাবারে পাহাড়ের ভালোবাসা মিশে আছে। এখানে চায়ের সাথে মেশানো হয় পাহাড় থেকে আনা মধু, পরিবেশন করা হয় সাজেকে চাষ করা কফি। যে কোন খাবারের আগেই তারা পরিবেশন করেন এক বাটি পাঁচমিশালী সবজি, যার নাম পাজন। ছুরি শুঁটকি এবং চিংড়ি দিয়ে রান্না করা এই খাবারটা এত সুস্বাদু হতে পারে, তা না দেখলে বোঝা যাবে না।

মোমো

নেপালি খাবার মোমো, কিন্তু প্রতি কামড়ে পাবেন পাহাড়ি মশলার স্বাদ। ছবি: কে এন দেয়া

এখানে খেয়ে যাবার পর আপনার নিঃসন্দেহে মনে হবে, অনেকদিন পর কোন রেস্টুরেন্টে সত্যিকারের স্বাস্থ্যকর খাবার খেলেন আপনি। কারণ অর্পণ চাকমার লক্ষ্য এটাই- Authentic, ethnic and healthy food। তিনি দুঃখ করে বলেন, যে কোন কুইজিনের প্রাণ তাতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন মশলা এবং হার্বস। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় তিনি ছোটবেলাতেও যেসব সবজি, হার্বস মেশানো পাজন খেতেন, এখন আর সেগুলো চোখেই পড়ে না। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে সেই খাবারগুলোর রেসিপি। এখনকার ছেলেমেয়েরা সেসব রাঁধতেও জানে না। এ কারনে তিনি সেই মাটির স্বাদ আঁকড়ে ধরে রাখতে চান, আবার তাতে নিয়ে আসতে চান প্রাণ। সিএইচটি এক্সপ্রেস এর মেনুতে তিনি ব্যবসার খাতিরে দুয়েকটা থাই, ভিয়েতনামিজ বা নেপালি খাবার রেখেছেন বটে, কিন্তু পাহাড়ি উপকরণ ব্যবহারে সেগুলোতেও এনেছেন দেশীয় ছোঁয়া।

আপনি যদি চাকমা খাবার খান, প্রথমেই তার সুন্দর রঙ চোখে পড়বে, খাবারের সুবাস আপনাকে মুগ্ধ করবে আর সবশেষে পাবেন এর সুস্বাদ, এমনটাই বলেন তিনি। বিজনেস পার্টনার সুখোদয় চাকমার সাথে মিলে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতেই সিএইচটি এক্সপ্রেস এর শুরু নতুন বছর থেকে। খুব দ্রুতই দেশীয় স্বাদ আবারো মানুষের ভালোলাগার জায়গাটা দখল করে নেবে, এমনটাই তারা আশা করছেন।

প্রিয় লাইফ/ আর বি