কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছেন অভিনেতা ও নাট্যনির্মাতা মাসুম আজিজ। ছবি: সংগৃহীত

ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে মুড়ি কিনে খেয়েছিলাম: মাসুম আজিজ

শিবলী আহমেদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:০৮
আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:০৮

(প্রিয়.কম) বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা ও স্বনামধন্য নাট্যনির্মাতা মাসুম আজিজ। যৌবনে নাটকের টানে পাড়ি জমিয়েছিলেন কংক্রিটের নগরী ঢাকায়। ছাত্রজীবনের শুরুর দিকেই মেধার স্বাক্ষর রাখায় তাকে চিকিৎসক বানাতে চেয়েছিলেন বাবা-মা। তবে মঞ্চ ও নাটক করতে খুব বেশি পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। কেননা, তার মা ছিলেন সংগীত অনুরাগী। বাবা পুলিশে চাকরি করলেও, বাঁশির সুর আয়ত্তে করে নিয়েছিলেন বেশ ভালোভাবেই।

মাসুম আজিজ নিজে গান না গাইলেও বাবার মতোই বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তার হাতে তবলার বোল ওঠে বেশ। পরিবারের সঙ্গে গোল বাধে যখন তিনি চিকিৎসক হতে চাইলেন না। মঞ্চটাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছিলেন তিনি। নিজের ইচ্ছা পূরণের আশায় মঞ্চের প্রেমে ঘরছাড়া হন তিনি। সেটি ১৯৭৬ সালের ঘটনা। পালিয়ে এসে উঠেছিলেন ঢাকার আরামবাগের একটি মেসে। এর পর নানা ধরনের চড়াই-উৎরাই, আর্থিক অনটন, চাকরির প্রতি অনীহা, ছাপাখানার ব্যবসায় সুবিধা না করতে পারা- এসব বিপত্তির মধ্যে থেকেও শুধু অভিনয়ের ওপর একাগ্রতার কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন আজকের ‘মাসুম আজিজ’

প্রারম্ভিক জীবনে ১৩ বছর মঞ্চ নাটক করার অভিজ্ঞতা নিয়ে মাসুম অডিশন দিয়েছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। সেটা ১৯৮৫ সালের ঘটনা। নাটক ও চলচ্চিত্রপাড়া মাতিয়ে পরিশেষে ঘানি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা হিসেবে অর্জন করেন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সালটি ছিল ২০০৬। এর পর কেটে গিয়েছে একটি যুগ।

অভিনয় জীবনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মাসুম যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন, যতটা সংগ্রাম ও কষ্ট করেছেন, সেসব বিষয়ে জানতে প্রিয়.কম ২১ জানুয়ারি রোববার যোগাযোগ করেছিল তার সঙ্গে। ঢাকায় পালিয়ে আসার আগের কাহিনি থেকেই শুরু হলো তার সঙ্গে আলাপচারিতা। তার ফেলে আসা দিনের সংগ্রামগুলোই  তুলে ধরা হলো প্রিয়.কমের সাপ্তাহিক আয়োজন স্ট্রাগল’-এ।

ঢাকায় পা রাখার আগের সময়গুলোর ফিরিস্তি টেনে মাসুম আজিজ প্রিয়.কমকে বলেন, আমার ওপর বাবা-মায়ের আশা ছিল অনেক বেশি। আমি ডাক্তার হতে পারতাম, কিন্তু পড়লাম না ডাক্তারি। পালিয়ে এলাম ঢাকায়। এক বছর গ্যাপ গেল। না খেয়ে থাকতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি তবলা বাজিয়ে ক্ষেপের টাকা দিয়েই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কেননা, যেহেতু ডাক্তারি পড়িনি, তাই বাবা খরচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

ঢাকায় এসে ক্ষুধা ও থাকার জায়গা নিয়ে যে ভোগান্তির মুখে পড়েছিলেন, সেটির বর্ণনা করে মাসুম আজিজ বলেন, যখন ঢাকায় আসি, তখন প্রথমে আমি এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম। সেখান থেকে আরামবাগের একটি মেসে উঠে যাই। প্রথম মাস যাওয়ার পর আমি আর মেসের ভাড়া দিতে পারিনি বিধায় আমাকে মেস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল এবং যে বুয়া আমাকে রান্না করে খাওয়াত, তার টাকা দিতে পারিনি বলে আমার ব্যাগটা আটকে দিয়েছিল।’

‘শুধুমাত্র একটা প্যান্ট ও শার্ট নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। সারাদিন বসেছিলাম আরামবাগের রাস্তায়, না খাওয়া অবস্থায়। পরে যখন দেখলাম যে রাত্রে সেখানে থাকা অসম্ভব, তখন চলে গেলাম অন্য একটি জায়গায়, সেখানে একটি ছাদে গিয়ে ঘুমালাম। তখনও আমি ক্ষুধার্ত।’

দুঃখের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে মাসুম বলেন, ‘‘পরের দিন যখন একেবারেই যা তা অবস্থা, দুপুরের পরপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম রাজাবাজার, আমার ছোট কাকার বাসায়। ততক্ষণে তাদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ। কারো কাছে গিয়ে খাবার চাইতে তো কেমন যেন লাগে। কিন্তু তখন আর পারছিলাম না। পরে ওখান থেকে বের হওয়ার সময় আমার যে চাচাতো ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কাছে এক টাকা হবে? ও বলল, না ভাইয়া, আমার কাছে চার আনা আছে। আমি বললাম, দে চার আনা। ওর থেকে চার আনা নিয়ে, ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে মুড়ি কিনে খেয়েছিলাম। তার পর ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আরামবাগ গিয়ে সেখানকার একটি হোটেল মেসিয়ারের সঙ্গে রাতে থাকলাম। ঢাকা শহরে টিকে থাকা তো অনেক কঠিন ব্যাপার। চারুকলার শাহ নেওয়াজ হলে অশোক কর্মকার নামে আমাদের দলের একটি ছেলে থাকত। কখনো সেখানে গিয়ে ঘুমাতাম, কখনো টিএসসিতে। কখনো সারাদিন না খেয়ে থাকতাম, কখনো দুদিন পর একদিন ভাত খাওয়া হতো। এ রকমই ছিল জীবনটা।’’

মাসুম আজিজের মুখের এমন হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে দীর্ঘদিনের অজানা সংগ্রামের কথা। ছবি : সংগৃহীত

টিভি নাটকে সূচনার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে মাসুম আজিজ প্রিয়.কমকে বলেন, আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে অডিশন দিয়ে পাস করার পর প্রথম টিভি নাটক শুরু করেছিলাম। টাকা পাওয়ার আশায় কিন্তু নাটক করিনি। শুধু করার জন্যই করা। অভিনয় বিক্রি করে খাব-এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না। নাটকের অনারিয়াম (সম্মানী) হিসেবে ১৯০ টাকা দিত। সেটি পাওয়ার পর, তিন চার মাসের মধ্যে আর কোনো নাটক করার সুযোগ পাওয়া যেত না। যারা টেলিভিশনে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকত, তারাই কাজ পেত। আমরা যারা মঞ্চ নিয়ে থাকতাম, টেলিভিশনে গিয়ে কোনো প্রোডিউসারের (প্রযোজক) কাছে ধরনা দেওয়ার কোনো সময়ও ছিল না, আমরা যেতামও না। ফলে টিভি নাটকের ওপর নির্ভর করব, সে রকম কোনো সুযোগই ছিল না। এক নাটক করে যে টাকা পেতাম, সেটি দিয়ে বিড়ি সিগারেটের পয়াসাও হতো না। তখনও মঞ্চ নাটক করা চালিয়ে যাচ্ছিলাম আমি।

এত টানাপড়েনের মধ্যে চাকরিও পেয়েছিলেন মাসুম আজিজ। কিন্তু মঞ্চ ও নাটকের ভালোবাসা তাকে চাকুরে হতে দেয়নি। বরেণ্য এ অভিনেতার ভাষ্য, যে চাকরিই করতে যাই, পোস্টিং হয় ঢাকার বাইরে। সে জন্য কোনো চাকরি না করে সারাদিন নাটকের পেছনে লেগে থাকতাম। সামনে কোনো স্বপ্ন বা ভবিষ্যৎ ছিল না। বিপরীত দিকে, আমার মধ্যে এ রকম কিছুও ছিল না যে আমি নাটক দিয়ে চলব। তার পরেও নাটকের প্রতি পাগলামিটা ছিল।

কিন্তু পুরোপুরি নিঃসম্বল হয়ে জীবনধারণ করা তো অসম্ভব। তখন খেয়ে, না খেয়ে কোনোমতে জীবনযাপন করতেন মাসুম আজিজ। আর্থিক কষ্টের সেই দিনলিপি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ঢাকা শহরে না খেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার বন্ধু-বান্ধব যারা তখন চাকরি করত, তাদের অফিসে গিয়ে গিয়ে, এটা সাপ্লাই, ওটা সাপ্লাই দিয়ে টিকে থাকতাম আরকি।

১৯৮২ সালে বিয়ে করেন মাসুম আজিজ। নতুন সংসার কিছু তো একটা করা চাই। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর কিছুদিন ছাপাখানার ব্যবসা করেছিলাম। সেই ছাপাখানাও টিকল না। আমি আবার একটু আঁকিয়ে ছিলাম। তাই এদিকে-ওদিকে ডিজাইন করে দেওয়ার কাজ করে চলতাম। সেটিকে আসলে চলা বলে না, কোনো রকমে টিকে ছিলাম।’

তিনি আরো বলেন, ‘‘বিয়ের পরপর ঢাকাতে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না কোনোভাবেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি চলে যাব। ওখানে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হওয়ার একটা অফার ছিল। বাবা মা-ও চাইছিলেন- আমি যাতে সেখানে যাই। ঠিক সেই সময়ে আমার ওস্তাদ, জনাব মামুনুর রশীদ বললেন, তুমি যদি ঢাকা ছেড়ে চলে যাও, তাহলে থিয়েটার ছেড়ে দেব। কত টাকা হলে তোমার চলে? কাল সকালে চলে এসো আমার অফিসে।’ এই ছিল মামুনুর রশীদের অফিসে আমার শুরু। তার পর থেকে আমি তার সহকারী হিসেবে ১০ বছর কাজ করেছি। সেই টাকা দিয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে কোনো রকম চলে যেত আমার। মামুন ভাই নিজেও টাকা-পয়সা দিতেন। ঢাকা শহরে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা করা দরকার, উনি আমার জন্য করেছেন।’’

পরপরই দিন ঘুরতে শুরু করে মাসুম আজিজের। স্বনির্ভরভাবে কাজ শুরু করলেন তিনি। ১৯৯২ সালে একটি এনজিওতে ভিজ্যুয়াল এক্সপার্ট হিসেবে চাকরি করতেন বর্তমানের এ নাট্য অভিনেতা। আজ তিনি সর্বজন পরিচিত। কিন্তু বিন্দুমাত্র অহংবোধ নেই তার। আর তাই হয়তো নিজের বিনয়ের পরিচয় দিয়ে শেষমেশ বললেন টেলিভিশনে কোনো স্টার হওয়ার জন্য আসিনি আমি।

প্রিয় বিনোদন/গোরা