ছবি: প্রিয়.কম
ভারতীয় উইপ্রোর কারণেই বন্ধ হলো একসেঞ্চার
আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৭, ১৮:৩৪
(প্রিয়.কম) বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইটি কোম্পানির একটি একসেঞ্চার গতকাল ১৮ জুলাই বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কেন বন্ধ করা হলো এর কারণ খুঁজতে নানান সমীকরণ মেলাচ্ছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তবে অনেকেই একসেঞ্চার বন্ধের কারণ হিসেবে দেখছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সফটওয়্যার পরিষেবা রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান উইপ্রোর বাংলাদেশ অপারেশনকে। সরকার থেকে প্রতিষ্ঠানটির এখনও কোন অনুমোদন না মিললেও ‘মুন্সি ট্রেডার্স’ নামে লোকবল নিয়োগের কাজ শুরু করেছে তারা।
উইপ্রোর বাইরে একসেঞ্চার থেকে টেলিনর পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, নতুন ব্যবসা না হওয়া, টেলিনরের অন্যান্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হতে না পারা এবং ইউনিয়ন কর্মীদের নানান ইস্যুতে ক্রমবর্ধমান চাপ ইত্যাদি কারণেও একসেঞ্চার বন্ধের ঘটনা ঘটেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিপিআইটির ৫১ শতাংশ মালিকানা নিয়ে ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে একসেঞ্চার। শুরুর দিকে টেলিনর গ্লোবালের চার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, ডিজি মালায়শিয়া, ডিট্যাক থাইল্যান্ড, এবং টেলিনর পাকিস্তানের দায়িত্ব পায় একসেঞ্চার। এশিয়ার এই চারটি দেশের সাথে সফল ব্যবসা করার পর টেলিনরের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল একসেঞ্চারের।
কিন্তু সম্প্রতি একসেঞ্চারের পর গ্রামীণফোনের আইটি ডিভিশনের সব কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সফটওয়্যার পরিষেবা রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান ‘উইপ্রো’কে। ইতোমধ্যেই গ্রামীণফোন উইপ্রোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। একসেঞ্চার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান শামসির পক্ষ থেকে সব কর্মীকে পাঠানো টার্মিনেশন লেটারে উইপ্রোর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ উইপ্রো থেকে জব অফার পেতে পারেন, যে প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রামীণফোন নিয়োগ দিয়েছে।
এদিকে এরই মধ্যে গত বছর একসেঞ্চারের হাতছাড়া হয়েছে টেলিনর পাকিস্তান। টেলিনর গ্লোবাল থেকে দায়িত্ব পাওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটির ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং নতুন করে কোন ব্যবসা না হওয়াতে বাংলাদেশে ব্যবসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে একসেঞ্চার।
একসেঞ্চারের টার্মিনেশন লেটারেও প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের একটি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে, আপনারা হয়তো জানেন ভবিষ্যত সেবা নিয়ে একসেঞ্চারের সাথে টেলিনরের (গ্রামীণফোনের মূল কোম্পানি) অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। আগামী বছরের শুরুর দিকে একসেঞ্চারের সাথে টেলিনরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ব্যবসার চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে কী করা যায়, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি কাজ করছিল। টেলিনরকে এখন যে সেবা দিচ্ছে একসেঞ্চার, তা এখন ইন-হাউজ এবং অন্যান্য সার্ভিস প্রোভাইডারদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে নতুন একটি সার্ভিস প্রোভাইডার ও টেলিনরের অন্যান্য দেশের অপারেশনে এ কাজ ভাগ হয়ে যাবে।
যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত উইপ্রো ব্যবসা করার কোন অনুমোদন পায়নি। তবে ‘মুন্সি ট্রেডার্স’ নাম দিয়ে লোক নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কর্মীরা অভিযোগ করে বলছেন, প্রায় আড়াইশ কর্মী উইপ্রোতে আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত মাত্র সাতজন ডাক পেয়েছেন। তবে তাদের কেউই নিয়োগ পাননি।
বাংলাদেশ থেকে একসেঞ্চারের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার বেশ কিছু কারণ প্রিয়.কমের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন একসেঞ্চারের সাবেক একজন কর্মকর্তা। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে একসেঞ্চার মূলত এসেছিল এশিয়ার দেশগুলোতে টেলিনরের চলমান ব্যবসা ধরার জন্য। প্রথমে এসেই তারা গ্রামীণফোন, ডিজি মালায়শিয়া, ডিট্যাক থাইল্যান্ড, এবং টেলিনর পাকিস্তানের দায়িত্ব পায়।
একসেঞ্চারের পরিকল্পনা ছিল, এশিয়ার মার্কেটে ভাল করলে পরবর্তীতে টেলিনর গ্লোবালের অন্যান্য অঞ্চলের দায়িত্ব পাবে। একসেঞ্চার বাংলাদেশে প্রথমত এসেছিল টেলিনর পাকিস্তানের জন্য। কিন্তু ২০১৬ সালে টেলিনর পাকিস্তান একসেঞ্চারের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তারা ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করে। ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করলেও আলাদা করে কোন ব্যবসা হচ্ছিল না একসেঞ্চারের।
ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, একসেঞ্চারের চলে যাওয়ার অন্যতম কারণের একটি ইউনিয়ন। নানান ইস্যুতে ইউনিয়নের চাপ নিতে পারছিল না একসেঞ্চার। টেলিকম অপারেটরদের বাংলাদেশ অবকাঠামো থাকলেও একসেঞ্চারের কোনো অবকাঠামো নেই। ফলে টেলিকম অপারেটরে ইউনিয়ন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হলেও একসেঞ্চার ইউনিয়নের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব ছিল না। ফলে তাদের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল।
একসেঞ্চার বাংলাদেশের হাতে থাকা চারটি প্রতিষ্ঠানের একটি টেলিনর পাকিস্তান চলে গেছে গত বছর। গ্রামীণফোনের অংশ এখন থেকে দেখবে ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠান উইপ্রো। বাকি দুই প্রতিষ্ঠান ডিজি মালায়শিয়া এবং ডিট্যাক থাইল্যান্ডকে একসেঞ্চারের ভারত অফিস থেকে সাপোর্ট দেওয়া হবে। যদিও মালায়শিয়াতে একসেঞ্চারের লোকাল অফিস এবং থাইল্যান্ডের নিজস্ব রিসোর্স থেকেও প্রতিষ্ঠান দুটির সাপোর্ট অব্যাহত থাকবে বলে সূত্র জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে একসেঞ্চার বন্ধ হওয়াতে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে একসেঞ্চার এমপ্লয়ী ইউনিউয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহীন আহমেদ প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বাংলাদেশে হঠাৎ সিদ্ধান্তে আইটি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আর এ খাতে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে এ ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
তবে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রিয়.কমকে বলেছেন, ‘একসেঞ্চার বন্ধ হওয়াতে আমাদের আইটি খাতে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। এখন বাংলাদেশে আইটি খাত মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা এখন বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্টের কাছাকাছি আছি। একসেঞ্চারের ১০ মিলিয়ন ডলারের মতো এক্সপোর্ট ছিল। আমাদের এই সাড়ে পাঁচশত ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়েছে এবং তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন আমাদের লিডিং যেসব আইটি কোম্পানিতে আছে এখন তারা সেখানে যাবে এবং তারা নিজেরাও উদ্যোক্তা হবে।’
পলক বলছেন, ‘বড় কোম্পানিতে চাকরি হওয়াতে বা তারা নিজেরাই যদি উদ্যোক্তা হয় সে ক্ষেত্রে আমরা আশা করছি আইটি খাতে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। আমাদের দেশীয় কোম্পানি ছাড়াও যেমন আইবিএম থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে আসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের সাথেও আমাদের কথা বার্তা হচ্ছে।’
একসেঞ্চার চলে যাওয়াতে বাংলাদেশে আইটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবে কিনা? উত্তরে জুনাইদ আহমেদ পলক প্রিয়.কমকে বলেন, আমার তা মনে হয় না। সব শেষে জানতে চাওয়া হয়, চাকরিচ্যুত কর্মীরা এখন সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছে। তাদের সহযোগিতার ব্যাপারে সরকার কোন ধরনের উদ্যোগ নেবে কিনা? উত্তরে পলক বলেন, ‘আমরা একসেঞ্চারকে বলেছি যাদের চাকরি গেছে ন্যায্যতার ভিত্তিতে তাদের যেন দেনা-পাওনা পরিশোধ করে দেয় হয়।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘একসেঞ্চার বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে ইমেজের বড় ধরনের একটা সংকট তৈরি হবে। আরও যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায় বা সরাসরি আসতে চায়, তারা দ্বিতীয়বার ভাববে। আমরা যতই সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি করি না কেন, এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।’
জিপি আইটির সাথে প্রথম থেকে কাজ করেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সৈয়দ আলমাস কবির। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, আমরা যে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আশা করি এবং এখানে যে আমরা হাইটেক পার্ক বানিয়ে আশা করছি বিদেশি বড় কোম্পানি এখানে এসে অফিস সেট আপ করবে; সেটাতে একটা বড় প্রভাব পড়বে। একসেঞ্চারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়াতে অন্যরা এখানে বিনিয়োগ করতে ভয় পাবে।
কিন্তু কেন চলে গেল? উত্তরে তিনি বলেন, প্রথম থেকেই তাদের লিডারশীপে সমস্যা ছিল। তবে একই সময়ে ফরেন ইনভেস্টমেন্টে নিরুৎসাহিত হলেও উইপ্রো বাংলাদেশে আসার কারণে একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে। উইপ্রো হয়তো বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারকেও রাখবে এবং অন্যদের জিপি ফিরিয়ে নিতে পারে। আমরা আশা করছি উইপ্রো বাংলাদেশে ভাল উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হবে।
এ ব্যাপারে একসেঞ্চারের মার্কেটিং অ্যান্ড কমিউনিকেশনের টিম লিড শবনম খান এক অফিসিয়াল স্টেটমেন্টে লিখেছেন, এশিয়া ও ইউরোপে বিভিন্ন কার্যক্রম পুনরায় জোরদার করতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে টেলিনর গ্রুপ ও একসেঞ্চার। আর এ কারণে একসেঞ্চার কমিউনিকেশনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার সলিউশনস লিমিটেডের (এসিআইএসএল) নিজ কার্যালয়ে চলমান কিছু কার্যক্রমে (সেবায়) রদবদল আনা হচ্ছে। আরও কিছু কার্যক্রম তৃতীয় পক্ষের হাতে স্থানান্তর করা হবে। এসিআইএসএল কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবর্তিত অবস্থায় তৃতীয় পক্ষের দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী কাজের সুবিধা পাবেন। প্রতিষ্ঠান সব র্কমীর এই পরিবর্তনকালীন সময়ে সব ধরনের যথার্থ সহযোগিতা করবে।
প্রিয় টেক/মিজান