ছবি সংগৃহীত
৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা
আপডেট: ০৪ মে ২০১৫, ১৮:৪৪
(উমর হাদী, ইনকিলাব) রাজধানীসহ সারা দেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার কম্পনের আশঙ্কা রয়েছে। আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে এ ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও জরিপ সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে ৬ থেকে ৮ মাত্রার অন্তত ছয়টি ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। গবেষকদের মতে, ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বিহার, আসাম নেপাল ও মিয়ানমারের প্লেটে ফাটল বা চ্যুতি থাকায় এসব অঞ্চলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে তার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে সিলেট, উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা অঞ্চলে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের প্লেটটি দেশের পূর্বাংশে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানিয়েছে ওই গবেষণা সংস্থাটি। বাংলাদেশকে মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে শনাক্ত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ভূমিকম্প ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে আঘাত আনতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা তো রয়েছেই, সে সঙ্গে ৬০০ কোটি ডলারের ক্ষতির মুখে পড়বে দেশ। ঢাকা থেকে মিয়ানমার ফাটলের দূরত্ব ৫০ থেকে শুরু করে ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে। ফলে এটা বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর সৈয়দ আক্তার হুমায়ুন তার গবেষণায় বলেছেন, পৃথিবীর সব থেকে বড় ডল্টো হলো ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা। এটা নবগঠিত একটি নরম মাটির এলাকা। এখানে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তা ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ, এসব স্থাপনা নির্মাণকাজে যেমন ত্রুটি রয়েছে- তেমনি ভূমির গঠনেও রয়েছে ঝুঁকি। নেপাল থেকে ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ। ফলে নেপালের এ ভূমিকম্পের পর শঙ্কা-আতঙ্ক আরো বেড়েছে। কারণ, নেপালে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ৬ মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। আর ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিই বা কি ধরনের হবে যদি বাংলাদেশে তা সংঘটিত হয়। যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড রথারি এ অঞ্চলের ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। তিনি এ বিষয়ে সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, হিমালয়ের পর্বতমালা ভারতীয় প্লেটের ওপর দিয়ে প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। সেখানে দুই থেকে তিনটি বড় ধরনের চ্যুতি রয়েছে। আর আছে কিছু খুব মৃদু গতিতে সঞ্চরণশীল চ্যুতি। এগুলোর সঞ্চরণের কারণেই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আক্তার হুমায়ুন ‘EARTHQUAKES OF DHAKA’ শীর্ষক শীরোনামে এক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে যেমন রয়েছেন। তেমনিভাবে ঢাকা বিশ্বের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ২০ শহরের একটি। গবেষণায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৫০ বছরের ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের অন্যতম ২০ শহরের একটি। এ অঞ্চলে তিনটি প্লেট সক্রিয় রয়েছে। এগুলো হলো, ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় প্লেট, ইউরোশিয়া প্লেট ও মিয়ানমার মাইক্রো প্লেট। এর মধ্যে ভারতীয় ও ইউরোশিয়া প্লেট প্রতি বছর পরস্পরের দিকে ২ ইঞ্চি করে এগিয়ে আসছে। আর মিয়ানমার মাইক্রো প্লেটটি দেশটির উত্তর-পূর্বে ১ ইঞ্চির কম করে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের এই প্লেটটির কারণে ভারতের আসামের সিলংয়ে একটি ফল্ট বা ফাটল হয়েছে যা ৩০০ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ সিলেটের সুরমা বেসিনে এসে পৌঁছেছে। আর মিয়ানমারের মাইক্রো প্লেটটির আরেকটি দিক বাংলাদেশের দক্ষিণের চট্টগ্রাম থেকে সুমাত্রার দিকে যাচ্ছে। এই প্লেটটির কারণে মিয়ানমারে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ঢাকা ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেন, ‘আমাদের উত্তরে দুটো সোর্স বা উৎপত্তিস্থল রয়েছে, যেগুলো খুবই বিপজ্জনক। আমাদের পূর্বে যে পাহাড়ি অঞ্চল, যেমন মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার এখানেও একটা উৎসস্থলে রয়েছে। সে হিসেবে উত্তর থেকেও আমাদের ঝুঁকি রয়েছে, পূর্ব থেকেও একটা ঝুঁকি রয়েছে।’ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ এই এক বছরেই দেশে ৪ থেকে ৫ মাত্রায় প্রায় ৯০টি ভূমিকম্প হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সংঘটিত হয়েছে ২০টি। বুয়েটের গবেষণায় দেখা যায়, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, রাজশাহীর তানোর, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের ডুবরী, সীতাকু-, সিলেটের শাহজীবাজার ও রাঙামাটির বরকলে আটটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির সহায়তায় বুয়েটের গত বছরের গবেষণায়ও বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির কথা উল্লেখ রয়েছে। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ইউএসজিএস বলছে, আগামী এক বছরে এই ফল্ট জোনে ৭ মাত্রার একটি, ৬ থেকে ৭ মাত্রার পাঁচটি আর ৪ থেকে ৬ মাত্রার অসংখ্য ভূকম্পন হতে পারে।’ দেশের মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ বলছে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে এমন নরম মাটি সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে, শতকরা ৮০ ভাগ। সিলেটে ৭০ আর ঢাকায় এর অনুপাত ৬৫ ভাগ। নরম মাটিতে স্থাপনা বেশি হওয়ায় ঝুঁকির কথাও জানানো হয়েছে ওই বিশ্লেষণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘ফাটল রেখার দৈর্ঘ্য এবং ফাটল রেখার সময় বিবেচনায় যে শক্তি রিলিজ হয়েছে, তার টোটাল শক্তির তিন ভাগের এক ভাগ শক্তি ভূ-অভ্যন্তর থেকে বের হয়ে এসেছে। পূর্বে যদি ভূমিকম্প হয়, তবে এক রকম হবে এবং পশ্চিমে যদি হয়, তবে ফল আরেক রকম হবে।’ ভূমিকম্প রোধে উদ্যোগের ধীরগতির কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে থেকেও ফায়ার ব্রিগেড বলছে, প্রস্তুতি আছে তাদের। তবে তার আগে প্রয়োজন সমন্বয় পরিকল্পনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার কথা জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান। তিনি বলেন, ‘ইকুইপমেন্ট ও ম্যান পাওয়ার এবং অন্যান্য ভেহিক্যাল যেগুলো আছে, ট্রান্সপোর্টেশন সব মিলিয়ে আমরা প্ল্যান করেছি। এগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।’ সে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাড়াতে প্রশিক্ষণ বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য বিপর্যয় রোধে এর কারণ চিহ্নিত করে তা দূর করতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। সে সঙ্গে ভূমিকম্পে করণীয় বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বানও জানিয়েছেন তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকি শহরে ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের একটি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিল। এতে প্রায় ৪০ হাজার) মানুষ নিহত হন। নাগাসাকি শহরটি সম্পূর্ণ ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। ফ্যাট ম্যান বোমার শক্তি ছিল ২০,০০০ টন টিএনটি’র (ট্রাই নাইট্রো টলুইন) সমতুল্য। এরকম ৫ হাজার বোমা একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটালে যত শক্তি নির্গত হবে, তা ১০ কোটি টন টিএনটি’র সমতুল্য। পারমাণবিক বিস্ফোরণের শক্তির একক হিসেবে টন টিএনটি ব্যবহার করা হয়। ভূমিকম্পের শক্তি বোঝানোর জন্যেও এই একক ব্যবহৃত হয়। তার মানে নেপালের পোখরার ভূ-অভ্যন্তরের ১৫ কিলোমিটারে ফ্যাট ম্যান বোমার মতো ৫ হাজার বোমা বিস্ফোরণ সমতুল্য ভূমিকম্প হয়েছে। গত ৮০ বছরের মধ্যে নেপালে গতকালের ভূমিকম্পই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই এলাকায় এর চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। জিওহ্যাজার্ডসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ব্রায়ান টাকার বলেন, নব্বইয়ের দশকে তার প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ১৯৩৪ সালের মতো ভূমিকম্প যদি আবার ঘটে তবে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাবে। কারণ, নেপালের শহরগুলোতে বড় বড় দালান কোঠা উঠছে যা সহজেই ভেঙে যাবে। চলতি মাসেই জিওহ্যাজার্ডস তাদের তথ্যে জানিয়েছে, নেপালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ এবং কাঠমান্ডু অন্যতম বড় শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। শুধু কাঠমান্ডুতেই ১৫ লাখ মানুষ বাস করছে। জিওহ্যাজার্ডস ইন্টারন্যাশনাল নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার মতে, প্রতি ৭৫ বছর পর পর নেপালসহ ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হানছে। ৮১ বছর আগে ১৯৩৪ সালে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে নেপালের ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল এভারেস্ট থেকে ৬ মাইল দক্ষিণে। ১৯৮৮ সালে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে এক হাজার মানুষ মারা যান। সৌজন্যে: ইনকিলাব
- ট্যাগ:
- বাংলাদেশ
- ডাটা
- আন্তর্জাতিক
- ভূমিকম্প
- 1. বাংলাদেশ